শায়েখ আবদুর রাজ্জাক বিন ইউসুফ তার বহু ধর্মীয় বক্তৃতায় বলেছেন, এ দেশের জাতীয় সংগীত বাতিল করতে হবে। জাতীয় সংগীতে ঠাকুর যতবার বলেছে—ওমা তোমার আকাশ তোমার বাতাস, ততবার ঠাকুর কালি-মাকে উদ্দেশ্য করে বলেছে, ও কালি-মা তোমার আকাশ, তোমার বাতাস! আমি ৩২ বছর ধরে বলে আসছি, কালি-মার বাপের আকাশ? আকাশ আল্লার, বাতাস আল্লার।
এই হচ্ছে আমাদের দেশের শীর্ষস্থানীয় একজন আলেমের জ্ঞান! বাংলাদেশের মুসলমানদের দুর্ভাগ্য হচ্ছে তারা রবীন্দ্রসাহিত্য পড়ে না। না পড়েই সম্পূর্ণ সন্দেহের বশে তাঁর সম্পর্কে, যা তিনি নন, তেমন বিপরীত ধারণা পোষণ করে বসে।
হিন্দু ধর্মের প্রধান চারটি শাখা হলো বৈষ্ণবধর্ম, শৈবধর্ম, স্মার্তধর্ম ও শাক্তধর্ম। দেবী মা-কালী হিন্দু শাক্তসম্প্রদায়ের একজন গুরুত্বপূর্ণ আরাধ্য দেবী। শাক্তধর্মে দিব্যমাতৃকাশক্তি বা দেবী হলেন পরম ও সর্বোচ্চ ঈশ্বর। তাকে দেবী আদিপরাশক্তি বা পার্বতীর একটি রূপ হিসেবে পূজা করা হয়। তাকে মৃত্যু, সময় ও পরিবর্তনের কর্ত্রী বলে মনে করা হয়। তাকে সন্তুষ্ট করতে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষেরা পাঁঠাবলি প্রথা পালন করে আসছে শতাব্দীর পর শতাব্দী।
আমার মনে হয় ধর্মান্ধ হিন্দুদের মনের গভীরে শিকড়গাড়া এই প্রথার বিরুদ্ধে সাহিত্যভুবনে সবচেয়ে বলিষ্ঠ প্রতিবাদ যিনি করেছেন তাঁর নাম রবীন্দ্রনাথ।
‘রাজর্ষী’ উপন্যাস কিংবা ‘বিসর্জন’ নাটক কি কখনো পড়ে দেখেছে আবদুর রাজ্জাক বিন ইউসুফের মতো লোকেরা?
রাজর্ষী উপন্যাসে বিষয়বস্তু হলো : একদা রাজা গোবিন্দমাণিক্য নদীতে স্নান করতে যান, এবং সেখানে হাসি ও তাতা নামের দুটি ছোটো ছেলেমেয়ের সাথে পরিচিত হন। অল্প সময়ের মধ্যেই তাদের সঙ্গে স্নেহের সম্পর্ক গড়ে ওঠে রাজার। একবার রাজা মন্দির প্রাঙ্গণে পশুবলির পরেরদিন হাসি ও তাতাকে নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে নদীর ঘাটে তাজা রক্তের দাগ দেখতে পান। হাসি জিজ্ঞাসা করে এ কিসের দাগ? রাজা এ কথার উত্তর না দিতে পারায় হাসি আঁচল দিয়ে নদীর ঘাট মুছতে থাকে। এ ঘটনার পরেই হাসি প্রবল জ্বরে পড়ে। জ্বরের বিকারে বলতে থাকে “ও রক্তের দাগ কিসের?” এবং অবশেষে সে মারা যায়। এই ঘটনায় রাজা অনেক বড় আঘাত পায় এবং ঘোষণা করেন তার রাজ্যে এবার থেকে বলিপ্রথা বন্ধ। কিন্তু বাধ সাধে মন্দিরের প্রধান পুরোহিত রঘুপতি ও রাজার আপন ভাই নক্ষত্র রায়। রঘুপতি প্রচণ্ড ক্রোধে বলতে থাকে বলিদান প্রথা বন্ধ হবার দরুণ রাজ্যের বিনাশ অবশ্যম্ভাবী। রঘুপতির ক্রোধ ও তেজ এবং রাজার সহিষ্ণুতার এই টানাপোড়েন চলতে থাকে এবং এক সময় রাজা তার রাজ্য ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন। শেষ পর্যন্ত আমরা দেখি রঘুপতি বুঝতে পারেন যে বলিদানপ্রথা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও মানবতাবিরোধী। অন্তিমে সবাইকে হার মানতে হয় রাজা গোবিন্দমাণিক্যের কাছে। রবীন্দ্রনাথ জয় ঘটান মানবতার এবং পরাজয় ঘটান কুসংস্কারের।
এই হলো রবীন্দ্রনাথ! বিসর্জন নাটকেও প্রায় একই কাহিনির নাট্যরূপ দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। বিশ্বকবির গোটা জীবনে তিনি কখনো সনাতনী কোনো দেবদেবীর মূর্তিপূজা করেন নি। তিনি নিরাকার পরম ব্রহ্মায় বিশ্বাসী ছিলেন, যা অনেকটাই সেমেটিক ধর্মের (ইসলাম, খ্রিষ্টান, ইহুদি) একেশ্বরবাদের সাথে মেলে।
মূর্তিপূজার প্রবল বিরোধিতার কারণে রবীন্দ্রনাথ এবং তার বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ঐ সময়ের ধর্মান্ধ হিন্দুরা একপ্রকার সমাজচ্যুত করেছিল। আজও পর্যন্ত শান্তিনিকেতনে কালীপূজা তো দূর, এমন কী সরস্বতীপূজাও হয় না। রবীন্দ্রনাথের দর্শন এবং তাঁর উদারতা এবং তাঁর দুই বাংলাকে সমানভাবে ভালোবাসার প্রকৃত খবর যারা রাখে না তারাই ‘আমার সোনার বাংলার বিরোধী’। বিকৃত বিভ্রান্ত তথ্যই তাদের জ্ঞানের উৎস।