ঢাকা শহরের একটি নামিদামি স্কুলের ভূগোল ক্লাস। শিক্ষক লতিফ সাহেব একদিন ক্লাসের শুরুতেই কী মনে করে ছাত্রদের হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন : আচ্ছা বলোতো সবচেয়ে ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল কোনটি?
কোনো ছাত্র উত্তর দিল জাপান। কোনো ছাত্র বললো ইন্দোনেশিয়া, কেউ বললো ফিজি। কেউ বললো ফিলিপাইন। সুমাত্রা, রাশিয়ার কামচাটকা উপদ্বীপ এ রকম বিভিন্ন অঞ্চলের নাম আসতে থাকল শিক্ষার্থীদের উত্তরে। অ্যালিসিয়ান দীপপুঞ্জ ও আলাস্কার নামও কেউ কেউ উচ্চারণ করলো। এতরকম উত্তর পেয়ে শিক্ষক নিজেই দিশেহারা।
শেষমেশ ক্লাসের ফার্স্টবয়, অত্যন্ত ভদ্র ও ধর্মপ্রাণ ছাত্র ফয়সালকে জিজ্ঞেস করলেন একই প্রশ্ন।
ফয়সাল উঠে দাঁড়িয়ে দিলো এক অবাককরা উত্তর। ফয়সাল আগে স্যারকেই জিজ্ঞেস করলো—শুধু পৃথিবীর ভূকম্পপ্রবণ এলাকার নাম বলবো, নাকি তামাম বিশ্বজগতের সবচেয়ে ভূকম্পপ্রবণ অঞ্চলের নাম বলবো?
ফয়সালের আত্মবিশ্বাসী প্রশ্ন শুনে শিক্ষকের উৎসাহ এবং ঔৎসুক্য আরও বেড়ে গেল। ‘তামাম বিশ্বজগতের সবচেয়ে ভূকম্পপ্রবণ এলাকা!’—এ তো আমারও জানা নেই—মনে মনে ভাবলেন শিক্ষক।
ফয়সালের মুখের দিকে হা-করে তাকিয়ে আছে সবাই। এমন সময় সে তার যুগান্তকারী উত্তরটি সবার সামনে বলে দিল।
—স্যার, ত্রিভুবনের সবচেয়ে ভূকম্পপ্রবণ এলাকা হলো আল্লাহ্-র আরশ। পান থেকে চুন খসলেও এটি থরথর করে কেঁপে ওঠে।
ফয়সালের এই উত্তরে শিক্ষক লতিফ সাহেব ভীষণ ক্ষেপে গেলেন। ‘ফাইজলামি করিস? খোদার আরশ নিয়ে ফাইজলামি?’ দাঁত মুখ খিঁচিয়ে রাগে গরগর করতে করতে লতিফ স্যার ফয়সালকে ধমক দেয়।
শিক্ষকের আচমকা ধমক খেয়ে ভীষণ কষ্ট হয় ফয়সালের। ঠিক ফাজলামো করার জন্য এমন উত্তর দেয় নি সে। পাঁচওয়াক্ত নামাজ তো আছেই, রমজানে সবকটি রোজা রাখে ফয়সাল। দারুণ পরহেজগার ছেলে সে। তার কাছে যা সত্য মনে হয়েছে সাদাসিধেভাবে তা বলে ফেলেছে। তাই বলে স্যার এমন দুর্ব্যবহার করবে?
নিজের উত্তরের পক্ষে এবার সে যুক্তি দেয়া শুরু করে এভাবে :
স্যার, মাজলুমের চোখের জলে আরশ কাঁপে।
স্ত্রী তালাক দেয়ার সময় আরশ কেঁপে ওঠে।
ইয়াতিমের বদদোয়ায় আরশ কাঁপে।
পিতা-মাতার দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকালে আরশ কাঁপে।
ফাসেকের প্রশংসা করা হলে আরশ কাঁপে।
পৃথিবীর কোনো-না-কোনো প্রান্তে সবসময়ই এ কাজগুলো চলতে থাকে। কেউ তার স্ত্রীকে তালাক দেয়। কেউ ফাসেকের প্রশংসা করে। সব সময়ই কোথাও-না-কোথাও মাজলুম তার চোখের জল ফেলে। ইয়াতিমের প্রতি অবিচার কোথাও-না-কোথাও হচ্ছেই। আর এ সবের জন্য যদি আরশ থরথর করে কেঁপে ওঠে তাহলে সবচেয়ে ভূকম্পনপ্রবণ এলাকা কোনটি হওয়ার কথা? আপনিই বলুন স্যার।
মডারেট মুসলিম লতিফ স্যার এবার ঢোক গিলে ফয়সালকে বোঝানোর চেষ্টা করেন।
—আসলে এগুলো মানুষের বানানো কথা। আল্লাহর আরশ কাঁপে এর পক্ষে দলিল কী?
ভালোছাত্র ফয়সালও ছাড়ার পাত্র নয়। স্যারকে সে রেফারেন্স দিয়ে চেপে ধরলো। জাকির নায়েক স্ট্যাইলে খই ফোটার মতো মুখে হাদিসের নাম্বার ফুটতে লাগলো ফয়সালের।
স্যার, মিশকাত শরিফের ৪৮৫৯ নম্বর হাদিসটি একবার দেখুন। “হজরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : যখন কোন পাপীলোকের প্রশংসা করা হয়, আল্লাহ তা’আলা ক্রুদ্ধ হন এবং তার প্রশংসার কারণে আল্লাহ তা’আলার আরশ কেঁপে ওঠে।”
বায়হাক্বী-শো‘আব ৪৮৮৬ নং হাদিসেও আরশ প্রকম্পিত হওয়ার কথা বলা আছে স্যার।
ছাত্রকে এবার একপ্রকার জোর করে থামিয়ে দেয় লতিফ সাহেব। বলেন—তুই যে রেফারেন্সগুলো দিচ্ছিস এগুলোর অধিকাংশই জঈফ হাদিস। এগুলোর সনদ মতন দুর্বল। পারলে ছহি্ হাদিসগ্রন্থ থেকে একটা রেফারেন্স দে।
ক্লাসের ফার্স্টবয় ফয়সাল এক নাছোড়বান্দা। সে এবার ছহি্ বুখারী, ছহি্ মুসলিম থেকে হাদিস আওরাতে লাগলো।
বললো—স্যার, আরশ এতই ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা যে নবীজির ছাহাবির মৃত্যুতেও তা কেঁপে ওঠার ছহি দলিল আছে। আমার কথা বিশ্বাস না হলে দয়া করে গুগলে এখনই বুখারী শরিফের ৩৮০৩ নম্বর হাদিসটি সার্চ দিন স্যার। সেখানে দেখতে পাবেন—
“জাবির ইবনু আবদুল্লাহ আনসারী (রাঃ) বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি সা’দ ইবনু মু’আয (রাঃ)-এর মৃত্যুতে আল্লাহ্ তা’আলার আরশ কেঁপে উঠেছিল।”
এই একই হাদিসের সত্যতা আপনি মুসলিম শরিফের ২৪৬৪ নম্বর এবং মিশকাত শরিফের ৬১৯৭ নম্বর হাদিসেও পেয়ে যাবেন। এগুলো বিশুদ্ধ বা ‘ছহি’ হাদিস রূপে স্বীকৃত স্যার।
ফয়সালের রেফারেন্সের কাছে নাস্তানাবুদ হয়ে লতিফ সাহেব এবার সকল হাদিসকেই আহালে কুরানদের মতো ‘জাল/জয়িফ’ বলে রায় দিতে শুরু করেন। তর্কেতর্কে ধীরেধীরে গলা শুকিয়ে আসে লতিফের।
আরশ কাঁপা-কাঁপি নিয়ে এত ধাপাধাপি হওয়ার এমন মুহূর্তে ক্লাসের এক মেয়েলি স্বভাবের ছেলে হঠাৎ জিজ্ঞেস করে বসলো :
‘স্যার আমি শুনেছি সমকামিরা এক হলেও নাকি আল্লাহর আরশ কাঁপে! এটি কি সত্যি স্যার?
ক্লাসে ‘নটিবয়’ খ্যাত সবচেয়ে দুষ্টু ছেলে রাফসান পেছন থেকে ফিসফিসিয়ে উত্তর দিল : আরশ না কাঁপলেও খাট যে কাঁপে এতে কোনো সন্দেহ নাই।
ক্লাসের সবারই সে দিন হাসতে হাসতে খুন হওয়ার অবস্থা।
অণুগল্প : আরশ
আবদুল্লাহ আল তারেক
১২ নভেম্বর ২০২২