ক) জাকির নায়েক তার একটি লেকচারে বলেছেন, ” ডাক্তার যেমন আপনাকে ঔষধ খেতে বলে এবং সেটা আপনার প্রয়োজন, ডাক্তারের প্রয়োজন নয়। তেমনি ইবাদতও মূলত আপনার প্রয়োজন, আল্লাহর নয়।”
প্রথমত তিনি মিথ্যাচার করেছেন। কেননা, আল্লাহ কুরআনে বলেছেন যে তিনি তার ইবাদাতের জন্য মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, প্রয়োজনটা যে আল্লার এই আয়াতটি পড়লেই বুঝা যায়। অথচ তিনি ডাক্তার সাথে মিলানোর জন্য হয় এই কথাটি গোপন করেছেন নয়তো ভুলে গিয়েছেন।
দ্বিতীয়ত, তিনি এখানে ডাক্তারের সাথে আল্লাহর তুলনা করতে গিয়ে ভুল উপমার কুযুক্তি দিয়েছেন। তুলনা করতে হলে যে বিষয়ে / বৈশিষ্ট্য নিয়ে দুটি জিনিসের মধ্যে তুলনা করা হয় ওই বিষয়/ বৈশিষ্ট্য দুটোর মধ্যেই থাকতে হয় বা এক হতে হয়। নয়তো তা ভুল উপমার/ অসম তুলনার কুযুক্তি হয়।
দেখুন, ডাক্তারের পরামর্শ বা হুকুম না মানলে ক্ষতি হয় যা বাস্তব। কিন্তু ইবাদাত না করলে তো কোন ক্ষতি হয় না। তাহলে কী দুটো এক হলো? তবুও এটা বাদ দিলাম। পরেরটা দেখুন৷
ডাক্তার তো ঔষধ না খাওয়ার কারণে মারে না বা শাস্তি দেয় না, তাই বলা যায় ডাক্তার নিজের প্রয়োজনে নয়, রোগীর প্রয়োজনেই রোগীকে ওষুধ খেতে বলেন। এমন যদি হতো আল্লাহ ইবাদাত করতে বলে, কিন্তু না করলে মারবে না। তাহলে এই যুক্তি ডাক্তারের সাথে যেতো এবং মানা যেতো যে আল্লাহও নিজের প্রয়োজনে নয়, বরং বান্দার প্রয়োজনে তাকে ইবাদাত করতে বলে। কিন্তু আল্লাহ তো ইবাদাত না করলে মারে/মারবে, জঘন্য মারা মারবে। এবং এই শাস্তিটা কোন সংশোধনের জন্যও নয়, বরং প্রতিশোধ হিসেবে)
তারমানে ইবাদাতটা আল্লারও প্রয়োজন এবং এই যুক্তি বা তুলনা ডাক্তারের সাথে সাথে যায় না।
খ) পুরুষের বহু বিবাহকে জাস্টিফাই করতে গিয়ে জাকির নায়েক এমন কিছু মিথ্যাচার এবং খুবই হাস্যকর কুযুক্তি দিয়েছেন যার কিছু উদাহরণ দেখুন :
১.উনি বলেছেন পৃথিবীতে নাকি পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা বেশি অথচ আপনি World Gender ratio নিয়ে গুগল করলেই আপনি অথেনটিক বিভিন্ন জরিপে দেখতে পাবেন যে পৃথিবীতে বরং নারীর চেয়ে পুরুষের সংখ্যা বেশি। অর্থাৎ এটা একদম ডাহা মিথ্যাচার।
২. উনি বলেছেন মানুষ নাকি প্রাকৃতিকভাবেই বহুগামী। যদিও ওনার কথাটি পুরোপুরি বা বৈজ্ঞানিকভাবে সত্য নয়। কেননা, মানুষ কি প্রাকৃতিকভাবে বহুগামী কিনা সেটা নিয়ে বিতর্ক আছে। ব্যাপারটা হলো অনেক মানুষ এবং প্রাণী প্রাকৃতিকভাবেই বহুগামী অনেকে প্রাকৃতিকভাবেই একগামী। অর্থাৎ, এখানে একগামীদের অস্বীকার করছেন।
৩. তিনি বলেছেন তবে অনেক পুরুষের নারীর চেয়ে চাহিদা বেশি। অথচ নারীর যে অনেক পুরুষের চেয়ে বেশি চাহিদা সেটা তিনি গোপন করেছেন।
এজন্য তিনি বলেছেন পুরুষ সেক্স করার জন্য বাজার থেকে রক্ষিতাও কিনতে পারবে আবার একাধিক বিয়েও করতে পারবে।
অথচ একটু যৌক্তিক বা নিরপেক্ষ বিচার করলেই বুঝা যায় এটা পক্ষপাতি। যেসব পুরুষদের চাহিদা বেশি তাদের জন্য একইসাথে রক্ষিতা রাখা এবং একাধিক বিয়ে দুটো অপশনই আছে, অথচ যেসব নারীর চাহিদা বেশি এবং তাদের স্বামী তা মেটাতে পারে না তাদের জন্য কোন অপশনই নেই।
৪. তিনি সূরা নিসার ৩ নং আয়াতের কথা উল্লেখ করেছেন যে তোমরা যদি আশংঙ্কা করো যে সুবিচার করতে পারবে তবে দুই, তিন অথবা চারটি বিয়ে করো। কিন্তু যদি আশঙ্কা কর যে সুবিচার করিতে পারবে না, তবে একটি বিয়ে করো। অথচ একই সুরার ১২৯ নং আয়াতে যে বলা হয়েছে, ”আর তোমরা যতই ইচ্ছে করোনা কেন তোমাদের স্ত্রীদের প্রতি কখনোই সুবিচার করতে পারবে না ; তবে তোমরা কোন একজনের দিকে সম্পূর্ণভাবে ঝুঁকিয়া পড়িও না ও অপরকে ঝুলানো অবস্থায় রাখিও না। ” এই আয়াতটি তিনি গোপন করেছেন। এটি পড়লেই বুঝা যায় যে সুবিচার না করলেও একাধিক বিয়ে করা যাবে।
গ) কুরআনের মতো তথাকথিত গুরুত্বপূর্ণ একটা কিতাবে ” পৃথিবী ৬ দিনে পৃথিবী বা মহাবিশ্ব সৃষ্টি করা হয়েছে ” এই একই অবৈজ্ঞানিক বা অযৌক্তিক কথা বহুবার বলা হয়েছে। এই কথাটি কেন অবৈজ্ঞানিক এবং হাস্যকর আলোচনা করছি না, একটু কমনসেন্স খাটালেই বুঝতে পারবেন। এক্ষেত্রে জাকির নায়েক ” সিত্তাতি আইয়ামের ” ক্লাসিক্যাল অর্থ ৬ দিন না ধরে তিনি বলেন এখানে নাকি দুনিয়ার সাধারণ দিন, বরং ৬ ধাপে সৃষ্টি করেছেন। অথচ তিনি এখানে পৃথিবী সৃষ্টি সম্পর্কিত সহিহ হাদিসগুলো গোপন এবং অস্বীকার করেছেন। কেননা, সহিহ হাদিস এবং ক্লাসিক্যাল তাফসীরগুলোতে যে আছে এখানে দিন বলতে সাধারণ দুনিয়াবি বা মানুষের বানানো দিনই বুঝিয়েছেন। তাছাড়া, কুরআনে কুরআনের সরল অর্থ এবং হাদিসকে অনুসরণ করতে বলা হয়েছে, কিন্তু কোথাও হাদিস বাদ দিয়ে জাকির নায়েকের কথা মানতে বলেনি।
নিচে আমি একটি হাদিস উল্লেখ করছি :
সুরায়জ ইবনু ইউনুস ও হারূন ইবনু ‘আবদুল্লাহ (রহঃ) ….. আবু হুরাইরাহ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার হাত ধরে বললেন, আল্লাহ তা’আলা শনিবার দিন মাটি সৃষ্টি করেন এবং এতে পর্বত সৃষ্টি করেন রবিবার দিন। সোমবার দিন তিনি বৃক্ষরাজি সৃষ্টি করেন। মঙ্গলবার দিন তিনি বিপদাপদ সৃষ্টি করেন। তিনি নূর সৃষ্টি করেন বুধবার দিন। তিনি বৃহস্পতিবার দিন পৃথিবীতে পশু-পাখি ছড়িয়ে দেন এবং জুমুআর দিন আসরের পর জুমুআর দিনের শেষ মুহূর্তে অর্থাৎ আসর থেকে নিয়ে রাত পর্যন্ত সময়ের মধ্যবর্তী সময়ে সর্বশেষ মাখলুক আদাম (আঃ) কে সৃষ্টি করেন। (ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৬৭৯৭,ইসলামিক সেন্টার ৬৮৫১)
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
এটা ছাড়াও একাধিক সহিহ হাদিস এবং সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য তাফসীরগুলোতে আপনি দেখবেন সেখানে দুনায়াবি দিনকেই বুঝিয়েছেন। অথচ জাকির নায়েক কুরআন সরল অর্থ বিকৃত করে, সহিহ হাদিস এবং গ্রহণযোগ্য তাফসিগুলো বাদ দিয়ে অজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছেন বা জেনেও সত্য গোপন করেছেন।
তার প্রায় সব লেকচারেই তিনি এমন কুযুক্তি, মিথ্যাচার, অর্থ বিকৃতি বা মনগড়া অর্থ সেট করা, তথ্য গোপন ইত্যাদি করে থাকেন। আমি তার শুধু ৩টি টপিকে দেয়া কিছু লেকচারের কিছু কুযুক্তি, মিথ্যাচার এবং তুলে ধরেছি। কিন্তুু তার শো গুলো পূর্বপরিকল্পিত এবং ধার্মিকরা সাধারণত ধর্ম দ্বারা বায়াসড বা ধর্মান্ধ বলে তারা এসব ভুল সাধারণত তাদের চোখে পড়ে না। বিষয়টা অনেকটা ম্যাজিকের মতো, অর্থাৎ আপনার মনোযোগের প্রতারণা করা। অনেকে ধরতে পারলেও ইসলামের স্বার্থে তারা সেটা বলে না। তাই আমাদেরই এসব বলতে হয়।