বহুল প্রচলিত কুযুক্তি -পর্ব ২

১৬. ভুল উপমার কুযুক্তি False Analogy Fallacy : 

এই ফ্যালাসিটি তখনই হয় যখন কেউ দুটি বস্তু বা বিষয়ের মধ্যে তুলনা করে তাদের মধ্যকার একটি সাদৃশ্যের ওপর নির্ভর করে আরেকটি সাদৃশ্য অনুমান করে। দুটি বস্তু বা বিষয়ের মধ্যে একটি ক্ষেত্রে মিল আছে মানে এটা নয় যে, তাদের মধ্যে অপর আরেকটি ক্ষেত্রে অবশ্যই মিল থাকবে। একটি মোবাইল ফোন আর একটি জীবদেহ উভয়ই অত্যন্ত জটিল মানে এটা নয় যে, মোবাইল ফোনটি কোনো কারিগরের অবদান বলে জীবদেহটিও কোনো কারিগরের অবদান হবে। এই যুক্তি অনুসারে আমরা দাবি করতে পারিঃ

◑ ছাগল স্তন্যপায়ী প্রাণী,

◑ ছাগল কাঁঠাল পাতা খায়।

◑ মানুষ স্তন্যপায়ী প্রাণী,

◑ অতএব, মানুষও কাঁঠাল পাতা খায়।

অবশ্যই, ছাগল এবং মানুষ উভয়ই স্তন্যপায়ী প্রাণী মানে এটা নয় যে, ‘ছাগল এবং মানুষ উভয়ই কাঁঠাল পাতা খায়।’

দাবী : “ঘড়ি খুব জটিল একটি বস্তু, সেকারণে একটি ঘড়ি দেখে আমরা বুঝতে পারি, এটি কোনোভাবেই আপনা-আপনি তৈরি হয়নি, বরং কোনো কারিগর তৈরি করেছেন। যেহেতু জীবদেহ বা আমাদের এই মহাবিশ্বও অত্যন্ত জটিল, সেহেতু জীবদেহ বা আমাদের এই মহাবিশ্বও আপনা-আপনি তৈরি হয়নি, বরং কোনো কারিগর তৈরি করেছেন। একটি ঘড়ির জন্য যেমন একজন কারিগর প্রয়োজন, তেমনি জীবজগৎ বা মহাবিশ্বের জন্যও একজন ঈশ্বর প্রয়োজন।” 

 একটি ঘড়ি দেখে বোঝা যায়, এটি কোনোভাবেই আপনা-আপনি তৈরি হয়নি, বরং একজন কারিগর তৈরি করেছেন। তার কারণ, আমরা আগে থেকেই জানি, একটি ঘড়ি আপনা-আপনি তৈরি হয়না, একজন কারিগর তৈরি করলেই তৈরি হয়।

একজন কারিগর দ্বারা একটি ঘড়ি তৈরি হওয়ার অসংখ্য উদাহরণ থাকলেও, একজন কারিগর ছাড়া আপনা-আপনি একটি ঘড়ি তৈরি হওয়ার একটিও উদাহরণ নেই। অপরদিকে, প্রাকৃতিকভাবে প্রকৃতিতে জীবদেহ জন্ম নেওয়ার অসংখ্য উদাহরণ থাকলেও, একজন কারিগর দ্বারা জীবদেহ তৈরি হওয়ার একটিও উদাহরণ আমরা খুঁজে পাই না।

একটি ঘড়ির জন্য অবশ্যই একজন কারিগর প্রয়োজন আর তার কারণ, একটি ঘড়ি প্রাকৃতিকভাবে প্রকৃতিতে জন্ম নিতে পারেনা, একটি অপর একটিকে জন্ম দিতে পারেনা। তাই, একটি ঘড়ি একজন কারিগর তৈরি করলেই তৈরি হয়। অপরদিকে, প্রাণী, উদ্ভিদ কিংবা প্রকৃতিতে বিদ্যমান সবকিছুই আমরা প্রাকৃতিকভাবে প্রকৃতিতে জন্ম নিতে দেখি আর এই জন্ম নেওয়ার ঘটনায় কোনো কারিগরের উপস্থিতি খুঁজে পাই না। অর্থ্যাৎ, একটি ঘড়ির জন্য অবশ্যই একজন কারিগর প্রয়োজন মানে এটা নয় যে, জীবজগৎ কিংবা মহাবিশ্বের জন্যও অবশ্যই একজন কারিগর প্রয়োজন।

অর্থ্যাৎ, ঘড়ি, মোবাইল ফোন, যানবাহন, রোবট ইত্যাদি মানবসৃষ্ট বস্তুর ক্ষেত্রে কারিগরের প্রয়োজনীয়তা একটি বাস্তবতা হলেও জীবজগৎ, গ্রহ-নক্ষত্র কিংবা মহাবিশ্বের ক্ষেত্রে কারিগরের প্রয়োজনীয়তা কেবলই একটি অনুমান। আপনি কেবল অনুমান করে নিতে পারেন জীবজগৎ বা মহাবিশ্বের পেছনে একজন কারিগরের অবদান আছে। আর এই অনুমানের অর্থ, জীবজগৎ বা গ্রহ-নক্ষত্র কিংবা মহাবিশ্বের জন্মরহস্য আপনি জানেন না এবং সেই অজানা স্থান পূরণ করতেই একজন কারিগর বা ঈশ্বর অনুমান করে নিয়েছেন।

তাছাড়া, একজন ঘড়ি-নির্মাতা শূন্য থেকে ঘড়ির জন্ম দেন না। একটি ঘড়ি তৈরিতে প্রকৃতিতে বিদ্যমান উপাদানসমূহই ব্যবহৃত হয়। আর প্রকৃতিতে বিদ্যমান উপাদানসমূহ অবশ্যই একজন ঘড়ি-নির্মাতার সৃষ্টি নয়।

১৭. কুপ্রশ্নের কুযুক্তি Begging the question :

দাবীঃ আপনি কেন খুন করেছেন? ( উনি খুন করেছেন কিনা তা প্রমাণের আগেই ) 

দাবীঃ আপনি আগে যেমন চুরি করতেন এখনো কী করেন?

দাবীঃ আল্লাহ না থাকলে কোরানে আল্লাহর কথা লেখা থাকবে কেন?

দাবী :  হনুমান না থাকলে এতো হনুমানের মন্দির আছে কেন?

উপরের দাবী প্রথম ও দ্বিতীয় দাবীগুলো থেকে দেখা যাচ্ছে, যিনি প্রশ্ন করেছেন, তিনি শুরুতেই ধরে নিয়েছেন, যাকে প্রশ্ন করেছেন তিনি খুনি, বা তিনি চোর। এই ধারণার ওপর ভিত্তি করে তিনি প্রশ্ন করেছেন, যেই প্রশ্নটিই ভুল। যদি আগে থেকেই শ্রোতা খুনি বা চোর প্রমাণিত না হয়ে থাকে, তাহলে এই ধরণের যুক্তিকে কুযুক্তি হিসেবেই গণ্য করা হয়।

তৃতীয় দাবীতে, উনি ধরে নিয়েছেন কোরানে যা লেখা তা সত্য, এবং আল্লাহ না থাকলে কোরানে আল্লাহর কথা কেন লেখা থাকবে? যুক্তিবিদ্যায় এরকম যুক্তি প্রদানকে কুযুক্তি বা ফ্যালাসি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। 

১৮. তালগাছ আমার কুযুক্তি Argument from final Consequences  :

উপস্থাপিত যুক্তি তথ্য প্রমাণ যাই হোক না কেন, যুক্তিতর্কের ফলাফল আপনি আগেই নির্ধারণ করে সেই বিশ্বাসে স্থির থাকলে তাকে আমরা বলি আর্গুমেন্ট ফরম ফাইনাল কন্সিকুয়েন্সেস। ধরুন আপনার বিশ্বাস হচ্ছে, বিবর্তনতত্ত্ব মিথ্যা। আপনি বিবর্তনতত্ত্ব নিয়ে বিতর্ক করতে আসলেন, এবং বিবর্তনের সপক্ষে সমস্ত তথ্য প্রমাণ যুক্তি শোনার পরেও, তার বিপরীতে উপযুক্ত তথ্য প্রমাণ যুক্তি দিতে ব্যর্থ হওয়ার পরেও আপনি বলতে থাকলেন, যত যাই হোক, বিবর্তনতত্ত্ব মিথ্যা। কারণ আপনার আস্থা যুক্তি বা প্রমাণে নয়, আপনার আস্থা বিশ্বাসে। এরকম অবস্থায় আপনার অবস্থানকে তালগাছবাদী কুযুক্তি বা ফ্যালাসি বলা হবে।

১৯.পক্ষপাতদুষ্ট নিশ্চিত কুযুক্তি Confirmation Bias Fallacy :

যেহেতু আপনি মুসলিম পরিবারে জন্মেছেন এবং ছোটবেলা থেকে ইসলাম ধর্মকেই সত্য বলে মেনে নিয়েছেন, তাই আপনার দাবী হচ্ছে, পৃথিবীর ৪২০০ টি ধর্মের মধ্যে আপনার ধর্মটিই একমাত্র সত্য এবং সঠিক। বাদবাকি সবই ভুয়া এবং বিকৃত। আপনি ভারতের কোন হিন্দু পরিবারে জন্মালে ঠিক একইভাবে একই যুক্তিতে হিন্দু ধর্মটিই পৃথিবীর একমাত্র সত্য ধর্ম বলে তখন আপনার মনে হতো। যেহেতু আপনি কোন ধর্মটি সঠিক তা তথ্য প্রমাণ দিয়ে যাচাই বাছাই না করে শুরুতেই এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, জন্মসূত্রে পাওয়া আপনার ধর্মটিই একমাত্র সঠিক, তাই আপনার দাবী পক্ষপাতদোষে দুষ্ট। তাই এই যুক্তিটি একটি কুযুক্তি বা ফ্যালাসি। পৃথিবীর বেশিরভাগ ধার্মিক মানুষই মনে করেন, তিনি যেই পরিবারে ঘটনাচক্রে জন্মেছেন, সেই পরিবারের ধর্মটিই একমাত্র সত্য। তিনি তার ধর্মের সপক্ষে যেসকল যুক্তি আছে, সেগুলো খুঁজে বের করেন, এবং সেইগুলোই প্রচার করেন। তার ধর্মের বিপক্ষের যুক্তিগুলোকে তিনি এড়িয়ে যান বা বাতিল করে দেন।

২০.স্ববিশেষ মিনতি কুযুক্তি Special Pleading Fallacy :

আপনার দাবীঃ সব কিছুরই স্রষ্টা থাকতে হবে। স্রষ্টা ছাড়া কোনকিছু এমনি এমনি হওয়া সম্ভব না।

প্রশ্নঃ তাহলে স্রষ্টার সৃষ্টি কীভাবে হয়েছে? কে করেছে? তিনি কী এমনি এমনি হয়েছেন?

দাবীঃ হ্যাঁ তিনি এমনি এমনিই হয়েছেন। তার কোন স্রষ্টার প্রয়োজন নেই। তিনি স্বয়ম্ভু, স্বয়ংসম্পূর্ণ।

প্রশ্নঃ কিন্তু আপনি কিছুক্ষণ আগেই তো বললেন, সবকিছুরই স্রষ্টা থাকতে হবে। সেই একই যুক্তিতে, স্রষ্টার স্রষ্টা না থাকাটা আপনার যুক্তির বরখেলাপ হয়ে গেল না?

দাবীঃ আল্লাহ একটি স্পেশাল ক্যারেকটার। উনি সৃষ্টির উর্ধ্বে। উনার স্রষ্টার প্রয়োজন নেই।

উপরের দাবী অনুসারে, প্রথমে তিনি একটি প্রস্তাব দিয়েছেন যে, সবকিছুরই স্রষ্টা থাকা অত্যাবশ্যক। পরে তিনি নিজেই আবার আল্লাহ বা ঈশ্বরকে সেই প্রস্তাবের বাইরে কিছু স্পেশাল সুবিধা দেয়ার দাবী জানিয়েছেন, এই বলে যে, উনি এই প্রস্তাব বা নিয়মের উর্ধ্বে। এটি একটি কুযুক্তি। একে বলা হয় স্পেশাল প্লিয়েডিং ফ্যালাসি। যখন কারও দেয়া সূত্র বা প্রস্তাব বা রুল সে বা অন্য কেউ ভঙ্গ করে, এবং সেই ভঙ্গ করাকে তিনিই স্পেশাল কিছু সুবিধা বলে চালিয়ে দিতে চান, তাকে আমরা স্ববিশেষ মিনতি কুযুক্তি বা ফ্যালাসি বলতে পারি।

২১. ব্যাখ্যা ও অজুহাত বা ন্যায্যতা প্রতিপাদনকে গুলিয়ে ফেলা  Confusing an explanation with an excuse :

কোন ঘটনার ব্যাখ্যা (explanation), অজুহাত (excuse) এবং ন্যায্যতা প্রদান(justification) তিনটি আলাদা বিষয়। কোন ঘটনার ব্যাখ্যাকে তার ন্যায্যতা প্রতিপাদন বা অজুহাত হিসেবে মনে করলে এই হেত্বাভাস হয়। অনেক মানুষই নানা ধরণের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে তথাকথিত ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করে, যা আসলে ব্যাখ্যা নয়, এক ধরণের অজুহাত। কোনটি ন্যায্যতা প্রতিপাদন, ব্যাখ্যা আর কোনটি অজুহাত, তা গুলিয়ে ফেলা অনেক মানুষেরই স্বভাব।

উদাহরণ :

১।

বক্তা ১ – পাকিস্তানীরা ১৯৭১ সালে বাঙলাদেশে গণহত্যা চালিয়েছিল।

বক্তা ২ – আপনার এইসব ঘটনার ব্যাখ্যা জানতে হবে। পরিপ্রেক্ষিত বুঝতে হবে। প্রেক্ষাপট বিবেচনা করতে হবে! সেসব না বুঝে আপনি এই কথা বলতে পারেন না।

বক্তা ১ – গণহত্যার আপনি কী ব্যাখ্যা দিতে পারেন?

বক্তা ২ – ঐ সময় খুব কঠিন সময় ছিল। ভারতের দালালরা পাকিস্তানকে ভাঙতে চেয়েছিল। ষড়যন্ত্রকারীরা চেয়েছিল পাকিস্তানের ক্ষতি করতে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা কেন হয়েছিল জানেন? সেই সময়ে কিছু বাঙালি দুর্বৃত্ত পাকিস্তানের সংবিধান লঙ্ঘন করেছিল। পাকিস্তান রাষ্ট্রের সাথে চুক্তি ভঙ্গ করেছিল। সেই সময়ে দেশপ্রেমিক পাক সেনাবাহিনী কঠোর হস্তে বিদ্রোহ দমন করে।

লক্ষ্য করে দেখুন, একটি গণহত্যাকে ন্যায্যতা প্রদান(Justification) করতে বক্তা ২ নানা রকম অজুহাত তৈরি করছেন। গণহত্যার সপক্ষে তিনি অজুহাত তৈরি করে সেগুলোকে ব্যাখ্যা মনে করছেন। কিন্তু ন্যায্যতা প্রদান, ব্যাখ্যা এবং অজুহাত একদমই আলাদা বিষয়। এই দুটো গুলিয়ে ফেলাকে Confusing an explanation with an excuse বলা হয়। উল্লেখ্য, গণহত্যা বা জাতিগোষ্ঠী, ধর্মীয় সম্প্রদায় ধরে নিধন চালানো কোন ব্যাখ্যাতেই বৈধ বলে গণ্য হয় না। কোন অবস্থাতেই ন্যায্যতা পায় না।

২।

– ভাবি, আপনার ছেলে কিন্তু আমাকে মোটেও সম্মান করেনা।

– কারণ সে মনে করে আপনার “আপনার চেহারা ডাইনির মত, যে বাচ্চাদের সহ্য করতে পারে না”।

– কিন্তু এটা কোন অজুহাত হতে পারে না।

– না, এখানে অজুহাতের কিছু নেই, এটা কেবলই তার আপনাকে পছন্দ না করার কারণ।

এখানে বাচ্চাটি মহিলাটিকে কেন সম্মান করে তার ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে মাত্র, কিন্তু বাচ্চাটি যে ঠিকই ভাবছে বা ব্যায্য কাজটি করছে বা বাচ্চার ভাবনাটাই যে ঠিক বা ন্যায্য সেটা বলা হয় নি, যা মহিলাটি ধরে নিয়েছিলেন।

৩।

– তুমি কেন বিগফুটকে মানুষ ও বানরের মধ্যকার মিসিং লিংক বলে মনে করছ?

– কারণ বিবর্তনগত প্রক্রিয়ায় দুটো প্রজাতির মধ্যবর্তী প্রজাতিকেই মিসিং লিংক বলে।

এখানে মিসিং লিংক কাকে বলে তার সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে, মানে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে, কিন্তু কেন সে বিগফুটকেই মিসিং লিংক বলে মনে করে এর ন্যায্যতা প্রতিপাদন করা হয়নি।

৪।

– ধর্ষণের পিছনে বিবর্তনগত কারণ রয়েছে। জীববিজ্ঞানী থর্নহিল ও এনথ্রোপলজিস্ট পালমার বলেন, একটি প্রতিযোগিতাপূর্ণ হারেম-বিল্ডিং স্ট্রাগলের কারণে লুজাররা ধর্ষণকে বিকল্প জিন প্রমোটিং স্ট্র্যাটেজি হিসেবে ব্যবহার করলে সুবিধা পাওয়া যায়, আর এর প্রভাব পরবর্তী প্রজন্মে আসায় পুরুষেরা ধর্ষণের প্রবণতা লাভ করেছে।

– এভাবে বলে তুমি ধর্ষণকে জাস্টিফাই(Justification) করছ, যেন ধর্ষণ খুব ন্যাচারাল, এটা হতেই পারে!

ধর্ষণের ইভোল্যুশনারি এক্সপ্লানেশন ধর্ষণের ব্যাখ্যা দেয়, অর্থাৎ মানুষ কেন ধর্ষণপ্রবণ হয় তার ব্যাখ্যা এখান থেকে পাওয়া যায়। কিন্ত এই ব্যাখ্যা কখনই ধর্ষণকে জাস্টিফাই করে না, বা ন্যায্যতা প্রদান করে না। অর্থাৎ ধর্ষণের পেছনে প্রাকৃতিক কারণও রয়েছে বলেই এটা নৈতিক এমন কিছু বলে না। আর সেই সাথে ইভোল্যুশন থেকে আসা প্রবণতা ধর্ষণের জন্য কোন এক্সকিউজ বা অজুহাতও হতে পারে না। এটা তাই অপরাধই থাকবে, কারণ মানুষের মধ্যে ধর্ষণ প্রবণতা থাকলেও নিজেকে কন্ট্রোল করার অপশন আছে। বিবর্তনের দ্বারা মানুষ নৈতিকতা ও সামাজিকতার বৈশিষ্ট্যই লাভ করেছে। এছাড়া মানুষের আচরণ কেবল জিনই নয়, পরিবেশও নিয়ন্ত্রণ করে। এছাড়া অপরাধ অর্থ সমাজের জন্য ক্ষতিকর কাজ, আর অপরাধী অর্থ যে এই ক্ষতিকর কাজটি করেছে।

রেস্টোরেটিভ জাস্টিসের বিধান অনুসারে অপরাধী যাতে অপরাধ থেকে নিবৃত হয় তাই শাস্তির প্রয়োজন, যেখানে শাস্তি অপরাধীকে অপরাধ থেকে নিবৃত করবার একটি প্রক্রিয়া। এক্ষেত্রে কেন অপরাধ সংঘটিত হয়েছে তাতে কিছু আসে যায় না, অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, এখন অপরাধীকে অপরাধ থেকে নিবৃত করার ব্যবস্থা করতে হবে, এটাই মুখ্য, তাই এক্সকিউজ বা এক্সপ্লানেশনে কিছু আসছে যাচ্ছে না।

তবে বৈজ্ঞানিক কারণ অনুসন্ধানে এবং মানুষের চরিত্র বুঝবার জন্য স্বাধীনভাবে বিবর্তনগত কারণ অনুসন্ধানের প্রয়োজন আছে যেখানে নৈতিক সিদ্ধান্ত আরোপনের মাধ্যমে এটা ঠিক কি ভুল- এই বিষয়ক মন্তব্য করার কিছু নেই, বরং এই অনুসন্ধান অপরাধ নিবৃতির কাজে সহায়তা করতে পারে, যা সমাজের জন্য মঙ্গলজনক হবে।

উপরের উদাহরণে একটি ঘটনার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা প্রদান এবং সেই ঘটনাকে জাস্টিফাই করার জন্য ব্যাখ্যা প্রদানকে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে। তাই এটি একটি লজিক্যাল ফ্যালাসি।তাহলে আমরা ব্যাখ্যা প্রদান এবং অজিহাতের মধ্যে পার্থক্য কীভাবে করবো?

অজুহাত > ধরুন, যখন কেউ বলবে, মেয়েটি ধর্ষিত হয়েছে, এখানে মেয়েটিরই দোষ ছিল। মেয়েটাই হয়তো কম কাপড় পরেছে, ছেলেটিকে উত্তেজিত করেছে, মেয়েটারই চরিত্রে দোষ আছে ইত্যাদি।

বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা > লক্ষ বছরের বিবর্তনের ধারায় বিভিন্ন প্রাণীর মধ্যে ধর্ষণের ইচ্ছা পরিলক্ষিত হয় বলে গবেষনায় দেখা গেছে। বিবর্তনের ধাপে ধাপে যেই প্রাকৃতিক নির্বাচন ঘটছে, সেখানে শারীরিকভাবে অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী একজন পুরুষ, যারা সাধারণত অন্য পুরুষের সাথে লড়াইতে কুলিয়ে ওঠে নি, তারা অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী নারীদের ওপর যৌন নির্যাতন চালিয়েছে। সেখান থেকে হওয়া বাচ্চারা সেইসব জিন বহন করেছে। সেই সাথে পারিপার্শ্বিক ঘটনা, সামাজিক নিয়মকানুন এবং শিক্ষা সেই সব বাচ্চাদের ভেতরে সেই সব জিন সচল করতে সাহায্য করেছে।

বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা যখন দেয়া হচ্ছে, সেটি কাজটির ন্যায্যতা প্রদান নয়। এখানে কোনভাবেই কাজটি নৈতিক নাকি অনৈতিক, সেই সিদ্ধান্তে যাওয়া হয় না। বিজ্ঞানের উদ্দেশ্যও তা নয়। বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য এইসব ঘটনার পেছনে কারণ অনুসন্ধান করা। যখন কারণগুলো সঠিক এবং বৈজ্ঞানিকভাবে নির্ণয় করা সম্ভব হবে, সমস্যাগুলো কীভাবে সমাধান করা যাবে তার উপায়ও মিলতে থাকবে।

২৩. চেরি পিকিং কুযুক্তি  

Cherry picking fallacy :

যখন আমরা কোন বিষয়ে বিভিন্ন রকম এভিডেন্স, ডেটা বা সম্ভাবনা থেকে আমাদের অনুকূলে যায় এরকম ডেটা বা এভিডেন্সকেই বা সম্ভাবনাকেই গ্রহণ করি তখন এই হেত্বাভাসটি সংঘটিত হয়।

উদাহরণ:

১।

দাবীঃ কোরানে বলা হয়েছে, পৃথিবী এবং আকাশ(মহাবিশ্ব) এক সময় একসাথে ছিল। আল্লাহ পাক তা আলাদা করেন যা বিগ ব্যাং তত্ত্বের দিকেই নির্দেশ করে।

প্রশ্নঃ বিগ ব্যাং তত্ত্বে কোথাও বলা হয় নি, পৃথিবী এবং মহাবিশ্ব এক সময় একই বিন্দুতে ছিল। আমাদের অবজারভেবল মহাবিশ্বের বয়স ১৩.৮ বিলিয়ন বছর। এবং পৃথিবীর বয়স ৪.৫৪৩ বিলিয়ন বছর। অর্থাৎ, পৃথিবী নামক কোন কিছুর অস্তিত্ব মহাবিশ্ব সৃষ্টির প্রায় ৯ বিলিয়ন বছর পরের ঘটনা। তাহলে, পৃথিবী এবং মহাবিশ্ব একসাথে ছিল, এরকম বলার পেছনে যুক্তি কী?

এছাড়াও, কোরান অনুসারে পৃথিবীকে আগে সৃষ্টি করা হয়েছে(সুরা ফুসসিলাত আয়াত ৯-১২), এরপরে আল্লাহ আকাশের দিকে মনোযোগ দেন। অর্থাৎ আকাশে আমরা যা দেখতে পাই, কোরান অনুসারে সে সবের বয়স পৃথিবী থেকে কম। অথচ, আমাদের কাছে এরকম তথ্য প্রমাণ রয়েছে যে, মহাবিশ্বের অসংখ্য নক্ষত্র পৃথিবীর চাইতে অনেক পুরনো, অনেক প্রাচীন। তাহলে, কোরানের দাবীগুলো সত্য কীভাবে?

> লক্ষ্য করুন, প্রথম কথাটির দাবীদার চেরি পিকিং করছেন। অর্থাৎ বিজ্ঞানের সাম্প্রতিক তথ্যের সাথে যতটুকু মিলছে, ততটুকুই উনি বলছেন। অন্যান্য বিষয়াদি উহ্য রেখে। তাই এটি একটি ফ্যালাসি, যাকে আমরা বলি চেরি পিকিং।

২।

আমাদের পলিটিকাল ক্যান্ডিডেট তার আয়ের ১০% অভাবীদেরকে দান করেন, প্রতি রবিবার চার্চে যান, এবং সপ্তাহে একদিন হোমলেস শেল্টারে গিয়ে স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করেন। তিনি একজন সৎ ও যোগ্য ক্যান্ডিডেট।

এখানে যে বিশেষগুলোর কথা বলা হয়েছে সেগুলোই যে তার সকল বৈশিষ্ট্যকে প্রতিফলিত করবে এমন কোন কথা নেই। হতে পারে তিনি অভাবী সেক্স ওয়ার্কারকে নিজের লাভের বিনিময়ে অর্থ দান করেন, প্রতি রবিবার চার্চ থেকে বেরিয়ে পাশের স্ট্রিপক্লাবে যান, আর প্রতি সপ্তাহে একদিন হোমলেস শেল্টারে যাবার কারণ সেখানে ড্রাগ ডিলারদের ঠেক বসে।

৩।

– আপনার সিভিতে লেখা যে আপনি খুব হার্ড ওয়ার্কার, সব কিছুতে আপনার অনেক মনোযোগ, এবং দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করতে আপনার কোন সমস্যাই নেই।

– ইয়েস স্যার।

– আমি আপনার আগের অফিসের বসের সাথে কথা বলেছি। তিনি বললেন, আপনি বারবার বিভিন্ন জিনিস পরিবর্তন করেন যা পরিবর্তন করা উচিৎ নয়, আপনি অন্যের প্রাইভেসি নিয়ে খুব একটা কেয়ার করেন না, আর কাস্টোমার রিলেশনের ক্ষেত্রে আপনার স্কোর খুবই খারাপ।

– ইয়েস স্যার। এগুলোও সত্যি।

– খুব ভাল। আমাদের সোশ্যাল মিডিয়া টিমে তোমাকে স্বাগতম!

সিভি, রেজিউম এসব চেরি পিকিং ইনফরমেশনের ক্লাসিক উদাহরণ। একটি রেজিউমে কেবল এই লেখা থাকে যে কেন আপনি পদটির জন্য যোগ্য। তবে বেশিরভাগ নিয়োগদাতাই বোঝেন যে এগুলো একপাক্ষিক, তাই তারা আরও বেশি এভিডেন্সের জন্য ইন্টারভিউ ও রিকমেন্ডেশন এর দ্বারস্থ হন।

৪। লোকটি ধর্ষকদের গণপিটুনির বিরুদ্ধে লিখছেন, নিশ্চই তিনি ধর্ষণ সমর্থন করেন ও তাদের প্রতি তার সমবেদনা কাজ করে।

ধর্ষকদের প্রতি সমবেদনা কাজ করা, ধর্ষকদের প্রতি সমর্থন থাকে, এসব ধর্ষকদেরকে গণপিটুনি দেবার বিরোধিতার কারণ হতেই পারে, কিন্তু এটাই এর একমাত্র কারণ নয়। মব জাস্টিস সমর্থন না করা, বিচারহীনতার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে থাকা, অপরাধীর আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগে বিশ্বাস করা ইত্যাদি অনেক কারণ থাকতে পারে এটা নিয়ে লেখার। কিন্তু এদের মধ্যে নিজের অনুকূলে কাজ করে এমন একটি সম্ভাবনা নিয়েই যদি দাবী করা হয় তাহলে চেরি পিকিং কুযুক্তি ঘটবে।

-সংশয়

  • Forhad H Fahad

    Related Posts

    ধর্ম না থাকলে মানুষ নৈতিকতা শেখবে কোথা থেকে? 

    ধরুন, একজন আধুনিক সভ্য মানুষ হিসেবে আপনার কাছে অবশ্যই যুদ্ধবন্দী নারীকে গনিমতের মাল হিসেবে বিছানায় নেয়া খুবই নিন্দনীয় কাজ বলে গণ্য হবে। কিন্তু এই কাজটি আপনার নবীজী নিজ জীবনে কয়েকবারই করেছেন, এবং অন্যদেরও করতে বলেছেন। বা ধরুন আপনি এমন কারও সাথে আপনার বোন বা কন্যাকে বিয়ে দেবেন না, যার ইতিমধ্যে তিনজন স্ত্রী আছে। আপনার বিবেক, বুদ্ধি, আধুনিক মূল্যবোধ, আধুনিক ধ্যান ধারণা আপনাকে সেইসব মধ্যযুগীয় কাজ করতে বাধা দেবে। যদিও…

    Read more

    পরকাল না থাকলে মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য কি?

    মুমিন ভাইটি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, স্রষ্টা না থাকলে, পরকালে বিচার আচার, পুরষ্কার বা শাস্তি না থাকলে, বেহেশত দোজখ না থাকলে আমাদের অস্তিত্বের কোন উদ্দেশ্যই থাকে না। এগুলো না থাকলে আমাদের অস্তিত্ব অর্থহীন হয়ে যায়। কোন আলটিমেট উদ্দেশ্য না থাকলে বেঁচে থাকার কোন মানে হয় না। তাহলে নাস্তিকদের এই অর্থহীন জীবনের মানে কী? তারা মরে যাচ্ছে না কেন? প্রশ্নটির উত্তর দেয়ার আগে আমার জানা দরকার, যেই স্রষ্টার কথা আপনি বলছেন,…

    Read more

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    Latest

    আমাদের জাতীয় সঙ্গীত কি হিন্দু শাক্তদেবী মা-কালীকে উদ্দেশ্য করে লেখা?

    আমাদের জাতীয় সঙ্গীত কি হিন্দু শাক্তদেবী মা-কালীকে উদ্দেশ্য করে লেখা?

    একেই কি বলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা?

    একেই কি বলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা?

    কর্ণচিকিৎসা

    কর্ণচিকিৎসা

    তাকদীর বিষয়ক রেফারেন্স

    তাকদীর বিষয়ক রেফারেন্স
    কুদরত

    পরকাল নিয়ে মুমিনদের বহুল জিজ্ঞেসিত প্রশ্নের জবাব

    পরকাল নিয়ে মুমিনদের বহুল জিজ্ঞেসিত প্রশ্নের জবাব