আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষই এটা জানে না এবং বুঝার চেষ্টা করে না যে বাল্যবিবাহ একটি চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন। অধিকাংশ পিতামাতাই নিজের মতামতকে সন্তানের উপর চাপিয়ে দেয় এবং এরমধ্যে অন্যতম হলো নিজেদের ইচ্ছা অনুযায়ী বাল্যবিয়ে করতে সন্তানকে বাধ্য করা। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, তারা মনে করে পিতামাতার পছন্দ বা সিদ্ধান্তই হলো সন্তানের পছন্দ এবং এমন ভুল উপদেশমূলক বাণী প্রচলিত আছে যে মা – বাবা যা করে ভালোর জন্যই করে , যদিও বাস্তবতা হলো ভিন্ন। অধিকাংশ মা বাবাই মানবাধিকার এবং সন্তানের অধিকার সম্পর্কে জ্ঞাত নয়।
পৃথিবীর যে কটি দেশ বাল্যবিবাহের প্রবণতা বেশি সেগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। ১৯২৯ সালের বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন অনুসারে বাল্যবিবাহ বলতে বুঝায় বাল্যকালে বা নাবালক বয়সে ছেলেমেয়ের মধ্যে বিয়ে। এ ছাড়া বর-কনে উভয়েরই বা একজনের বয়স বিয়ের দ্বারা নির্ধারিত বয়সের চেয়ে কম বয়সে বিয়ে হলে তা আইনত বাল্যবিবাহ বলে চিহ্নিত হবে। অথচ এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, আমাদের দেশে বেশির ভাগ মেয়ের বিয়ে হয় ১২ থেকে ১৮ বয়সের মধ্যে।
এই বাল্যবিবাহ নামক অভিশাপের সবচেয়ে বড় শিকার হলো এদেশের, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের মেয়েরা।একজন মেয়ে শিশু যখন বয়ঃসন্ধিতে উত্তীর্ণ হয়, তাদের পিতা-মাতা তখন তাদের সতীত্ব রক্ষার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে উঠে। কিশোরী মেয়েদের কোন উপায় থাকে না বলে তারা নিরুপায় হয়ে, সমাজ এবং পরিবারের কথা ভেবে নিজের শত স্বপ্ন এবং ইচ্ছাকে জলাঞ্জলি দিয়ে বিয়ে নামক স্থায়ী পতিতালয়ে ধর্ষিত হতে থাকে। অথচ একজন অপ্রাপ্ত বয়ষ্ক নারীর সাথে যৌনসঙ্গম যে ধর্ষণ তা অধিকাংশ মানুষই বুঝে না।
আরো একটি বড় সমস্যা হল এই অল্প বয়সী মেয়েদের সেক্স এজুকেশন এবং জন্মনিয়ন্ত্রণ এসব সম্পর্কে নূন্যতম ধারণা থাকে না। ফলে তারা সেক্স করার সঠিক পদ্ধতি সম্পর্কে জানে না বলে প্রবল ব্যাথার শিকার হয় এবং অনেকের রক্তক্ষরণে মৃত্যুও হয়। তাদের বিভিন্ন যৌনসমসযায় ভুগলেও সেক্স এজুকেশনের অভাব এবং অতি লজ্জার কারণে তারা সেটা কাউকে বলতেও পারে না এবং ডাক্তারের শরণাপন্নও হতে পারে না। এসব কষ্টও তারা মুখচেপে সহ্য করে যায়।
তারা শুধু বৈবাহিক শিশু ধর্ষণের শিকারই হয় না, জন্মনিয়ন্ত্রণ এবং গর্ভপাত সম্পর্কিত জ্ঞানের অভাবে নিজের অনিচ্ছায় তারা অল্পবয়সেই সন্তানের মা হয়ে যায়। সন্তান লালন-পালনেরের ধৈর্য্য এবং যোগ্যতা হওয়ার জন্যও একটা ন্যনতম বয়সের প্রয়োজন হয়, কিন্তু বাল্যবিবাহের কারণে আমাদের দেশের অধিকাংশ মেয়েরা সঠিক বয়সের পূর্বেই মা হয়ে যায় যার ফলে সন্তানেরও সঠিক সামাজিকীকরণ বিঘ্নিত হয়।
বাল্যবিবাহের এতো সমস্যা থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন হুজুর ও ইসলামিক বক্তারা এসব সমস্যার কথা না ভেবে বরং তারা বাল্যবিবাহ ইসলামে আবশ্যক বলে প্রচার করে। এমনকি বাল্যবিবাহ না দিলে পিতামাতা জাহান্নামী হবে বলে ওয়াজ করে। ইসলাম এবং হিন্দু উভয় ধর্মেই এই বাল্যবিবাহকে প্রমোট করা হয় যা বাল্যবিবাহের অন্যতম প্রধান কারণ।
আমাদের সমাজে অন্যতম আরেকটি অস্বীকৃত ধর্ষণ হলো বৈবাহিক ধর্ষণ। দুঃখজনক হলে সত্য যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সেক্স এডুকেশন না থাকার কারণে কোনটি সঠিক যৌনমিলন আর কোন কোনটি সেটা অধিকাংশ মানুষ এবং শিক্ষার্থীরা জানে না। তারা মনে বিয়ে করা মানেই স্বামী যখন ইচ্ছে তখনই স্ত্রীর কোনধরনের সম্মতি ছাড়াই সেক্স করতে পারে, এমনকি প্রয়োজনে মারধর করার অধিকারও রাখে। এ যেন স্ত্রী একটি কেনা বস্তু।
অথচ মানুষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সেক্স করাটাই ধর্ষণ। হোক সে বিবাহিত স্ত্রী বা যে কেউ। সবার যে সবসময় সেক্স করার মুড থাকে না সেটা বুঝতে হবে। তাছাড়া, নারী কোন যৌনবস্তু নয় যে পুরুষ যখন চাইবে তখনই তাকে প্রস্তুত থাকতে হবে। নারীও যে মানুষ, তার নিজেরও যে অনুভূতি, সম্মতি আছে তা অধিকাংশ মানুষই বুঝতে চায় না। সঠিক, কষ্টহীন এবং উপভোগ্য যৌনমিলনের ক্ষেত্রে নারীর সম্মতি কেন গুরুত্বপূর্ণ তা অধিকাংশ মানুষই জানে না কারণ এ সমাজে যৌনতা ট্যাবু বলে এদেশের অধিকাংশ মানুষ সেক্স এডুকেশন বিরোধী। ফলে যৌনতা সম্পর্কে মানুষ সঠিক জ্ঞান লাভ করে না, উল্টো বিভিন্ন নারীবিরোধী ভুল ধারণা মানুষ লালন করে যেসবের খেসারত দিতে হয় নারীদের। আসলে, সেক্স এডুকেশনের অভাবে সবচেয়ে বেশি সমস্যার শিকার হতে হয় নারীদের যারা অন্যতম ফলাফল হলো বাল্যবিবাহ, বৈবাহিক ধর্ষণ এবং অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ ইত্যাদি।
এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্ম ইসলামও এই বৈবাহিক ধর্ষণের বৈধতা দেয় যা বৈবাহিক ধর্ষণ বিরোধী সচেতনতায় প্রধান বাধা। এছাড়াও, যে সেক্স এডুকেশনের অভাব এসব সমস্যার প্রধান কারণ, সেই সেক্স এডুকেশনের সবচেয়ে বড় বিরোধী হলো ধর্মান্ধ মুসলিম এবং তাদের ধর্মীয় গুরুরা। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সরকার নিজেকে মুখে মৌলবাদবিরোধী এবং নারীর প্রগতির পক্ষের বলে দাবি করলেও, এই মৌলবাদীদের খুশি রাখতে সরকার সেক্স এডুকেশনের মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কেও এড়িয়ে যাচ্ছে এবং মোল্লাদের কারণে স্কুলের শিক্ষার্থীদেরও যৌনশিক্ষা থেকে বিরত রাখছে যা হতাশাজনক। তবে আশা করি সরকার এবং নীতিনির্ধারকদের শুভবুদ্ধির উদয় হবে এবং তারা মৌলবাদীদের তোয়াক্কা না করে মানবাধিকার নিশ্চিতে কাজ করবে।