সমকামিতা শব্দটি শুনলেই এদেশের মানুষ তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে। এর প্রধান কারণ হলো ধর্ম এবং সমকামিতা সম্পর্কে মানুষের সঠিক জ্ঞানের অভাব। সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় কারণে সমকামিতা সম্পর্কে আমরা সঠিক জ্ঞান মানুষকে দিতে না পারলেও, সমকামিতা সম্পর্কে মিথ্যা এবং ভুয়া তথ্য ঠিকই ছড়ানো হয়েছে। তাই সমকামিতা সম্পর্কে মানুষকে সঠিক জ্ঞান দেয়া এবং এর বিরুদ্ধে অপপ্রচার এবং গুজব খন্ডন করা আমাদের মানবতাবাদীদের কর্তব্য। সমাজ নয়, মানুষের অধিকারই আমাদের কাছে মুখ্য।
এই উদ্দেশ্যে ২০১৩ এর পর থেকেই সমকামী সমর্থকরা প্রকাশ্যে কথা বলা শুরু করে। বাংলাদেশে সমকামীদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার ছিলেন জুলহাজ মান্নান৷ ২০১৪ সাল থেকে তাঁর সম্পাদনায় যাত্রা হয় সমকামিতা নিয়ে প্রথম ম্যাগাজিন ‘রূপবান’ এর। ২০১৬ সালের ২৫ এপ্রিল কলাবাগানের লেক সার্কাস রোডের এক বাসায় ঢুকে তাকে এবং তাঁর বন্ধু নাট্যকর্মী মাহবুব তনয়কে হত্যা করা হয়। নিপীড়িত যৌনসংখ্যালঘুদের অধিকারের জন্য জীবন উৎসর্গ করায় তারা আমাদের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাদের হত্যা করেছে বলে আমরা তো একদম অবদমিত হয়ে যেতে পারি না। যতটুকু নিরাপদে থেকে সম্ভব, আমাদের কথা বলতে হবে। সমকামিতা ট্যাবু ভাঙতে হবে।
সমকামিতা সম্পর্কে মানুষের ভুল ধারণা এবং জবাব :
প্রথমত, আপনি যেমন প্রাকৃতিকভাবেই বিষমকামী, ঠিক তেমনই সমকামীরাও প্রাকৃতিকভাবেই সমকামী। এর উপর তাদের কোন হাত নেই। আপনাকে যেমন চিকিৎসা বা থেরাপির মাধ্যমে বিষমকামী বানানো সম্ভব নয়, ঠিক সমকামির ক্ষেত্রেও তাই। আপনি যেমন চাইলে সমকামী হতে পারেন না, ঠিক তেমনি একজন সমকামী চাইলে বা চেষ্টা করলে তা হতে পারে না।
ধরুন, একটি সমাজে অধিকাংশ মানুষ সমকামী এবং সেখানে বিষমকামিতার স্বীকৃতি নেই। ফলে আপনাকে বা একজন বিষমকামীকে সমলিঙ্গের মানুষের সাথে বিয়ে এবং যৌনকর্ম করতে হয়, তখন আপনার কেমন লাগবে? কষ্টটা কি একটু অনুভব হয়?
অথচ এদেশে কত সমকামী নারী – পুরুষের অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিয়ে হচ্ছে এবং সমকামী মেয়েরা ধর্ষিত হচ্ছে, অনেকে আত্মহত্যা করে। আর সমকামী পুরুষরা যেহেতু সামাজিক কারণে বাধ্য হয়ে বিয়ে করে এবং বলতেও পারে না যে সে সমকামী। ফলে তাদের স্ত্রীদের কী করুণ অবস্থা হয়! অনেকে বাধ্য হয়ে পরকীয়ায় লিপ্ত হয়।
চিকিৎসা, থেরাপি বা কাউন্সিলং এর মাধ্যমে কি সমকামী থেকে বিষমকামী হওয়া যায়?
না। এমন কোন প্রমাণ নেই। বরং চিকিৎসা এবং থেরাপি দিতে গিয়ে অনেকেরই মৃত্যু হয়েছে কিন্তু কোন কাজ হয়নি। কাউন্সেলিং বা ধর্মীয় ভয় দেখি কিছু সময়ের সেক্স থেকে বিরত রাখা যায়, কিন্তু ওরিয়েন্টেশন পরিবর্তন করা যায় না।
সমকামিতা অপ্রাকৃতিক, যৌনবিকৃতি বা মানসিক রোগ?
সমকামিতা প্রাকৃতিক। শুধু মানুষের মাঝেই নয়, প্রাণীদের মাঝেও সমকামিতা দেখা যায় এবং এটি মানসিক রোগ তো নয়। ১৯৭৫ সালে World Health Organisation (WHO) এবং American Psychiatrist Association সমকামিতাকে মানসিক রোগ নয় বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন।
প্রাকৃতিক মানেই কি সেটা অপরাধ নয়?
ধর্ষণও তো প্রাকৃতিক, তাহলে সেটা অপরাধ হলে এটা কেন নয়?
ধর্ষণ অপরাধ, সেক্স নয়। ধর্ষণে অন্যকে জোর করে ইচ্ছের বিরুদ্ধে কষ্ট দেয়া এবং অধিকার হরণ করা হয় তাই অপরাধ। প্রাকৃতিক বলে নয়। সমকামিতায়ও যদি কেউ জোরপূর্বক সমকাম করতে চায় তবে সেটা ধর্ষণ এবং অপরাধ। সম্মতিতে করলে অপরাধ নয়।
সমকামিতায় সন্তান উৎপাদন সম্ভব নয়, এটা কি সমস্যা?
না। এটা কোন সমস্যা নয়, বরং এটা স্বাভাবিক এবং এটা পজিটিভ দিকও রয়েছে। সবাই সন্তান উৎপাদন হবে এমন কোন কথা নেই। তাহলে, পিতামাতাহীন উদ্বাস্তু শিশুদের কে পালবে? তারা তো ওসব শিশুদের দত্তক নিয়ে মানবিক কাজই থাকে। তাছাড়া, মানুষের সংখ্যা অতিমাত্রায় বেড়ে গেলে প্রকৃতিরই ক্ষতি। এক্ষেত্রে তারা সেই ভারসাম্য রক্ষা করে।
সমকামিতার স্বীকৃতি দিলে বিষমকামীরা সমকামী হয়ে যাবে এমন ধারণা একদম অবাস্তব।
সমকামিতার মাধ্যমে কি রোগ ছড়ায়?
আসলে ছড়ানোর সাথে সমকামিতা বা বিষমকামিতার সম্পর্ক নেই, সম্পর্ক হলো সচেতনতার। যেহেতু প্রাকৃতিকভাবে যৌনাঙ্গগুলো মলমূত্র বের হয়, তাই যৌনতার ক্ষেত্রে সচেতনতা অবলম্বন না করলে যে কারো ক্ষেত্রেই রোগ ছড়াতে পারে। আবার সচেতনতা অবলম্বন করলে নিরাপদ।
আরেকটি অন্যতম অভিযোগ হলো ধর্মে নিষিদ্ধ।
এখন কথা হলো ধর্মে তো অনেক কিছুই নিষিদ্ধ, কিন্তু যার ইচ্ছে সে করছে, যার ইচ্ছে সে করছে না। কিন্তু যৌন অধিকার ক্ষেত্রেই কেন ধর্মের দোহাই দিতে হবে।
আর ধর্ম হলো ধার্মিকের জন্য। সুতরাং যে ধর্মে বিশ্বাস করে সে সমকামী হওয়া সত্ত্বেও সমকামিতা থেকে বিরত থাকতে পারলে থাকুক। কিন্তু যে বা যারা ধার্মিক নয় সেসব সমকামীরা কেন তাদের অধিকারের স্বীকৃতি পাবে না। তাদের কেন ধর্ম চাপানো হবে?
১৯৭১ সালে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং জাতীয়তাবাদের উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। মূলভিত্তিতে গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা থাকলেও যৌনসংখ্যালঘুরা আজও স্বীকৃতি পায় নি। বরং সমকামীবিরোধী সেই পুরাতন বৃটিশ আইন ধারা ৩৭৭ এখনও বলবৎ রয়েছে। যেখানে বৃটেন – আমেরিকসহ প্রায় সব সভ্যদেশে সমকামিতা বৈধ। এমনকি সম্প্রতি ভারতের মতো দেশও সমকামিতাকে বৈধতা প্রদান করেছে অথচ বাংলাদেশ এখনও এ ব্যাপারে কঠোর।
বাংলাদেশের সংবিধানের যেখানে বলা আছে,
অনুচ্ছেদ ১৯ – সকল নাগরিকের সমান সুযোগের অঙ্গিকার।
ধারা ২৭ – সকল নাগরিকের জন্য আইনের দৃষ্টিতে সমান অধিকার রয়েছে।
অথচ সেখানে ৩৭৭ ধারা সংবিধানের অন্য ধারার বিরোধী। এখানে সকল নাগরিককে না দেয়া হয় সমান অধিকার, না দেখা হয় সমান দৃষ্টিতে। শুধু বিষমকামীদেরই সেক্স বিয়ে এসবের অধিকার বা সুযোগ আছে কিন্তু সমকামীদের তা নেই। যা স্পষ্ট বৈষম্য।
সবার আগে মানুষের অধিকার, পরে বাকিসব। অর্থাৎ ধর্ম বা সংস্কৃতি। তাই রাষ্ট্রের উচিৎ মানবাধিকারের কথা ভেবে LGBTQ এর স্বীকৃতি দেয়া ধারা ৩৭৭ বাতিল করা অথবা যৌনশিক্ষা পাঠদান আবশ্যক করে সমকামিতা সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান বিতরণের মাধ্যমে সমকামিতা – রূপান্তরকামিতা সম্পর্কে বা অন্যের যৌন অধিকার সম্পর্কে পজিটিভ ও সচেতন করা। অর্থাৎ, এখনই স্বীকৃতি দেয়া বা সমকামিতা বিরোধী আইন বাতিল করা সম্ভব না হলে অন্ততপক্ষে ভবিষ্যতে যেন সেটা সম্ভব সেই প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা।
References :
2.https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC4771012/
3.https://www.apa.org/topics/lgbtq/orientation
4.https://en.m.wikipedia.org/wiki/Homosexual_behavior_in_animals