১. যখনই কুরআন বা হাদিসের কোন বাণী মুমিনদের মনমতো না হয়, তখনই তারা গোঁজামিল দেয়ার জন্য বলে যে এটার ভিন্ন অর্থ, ব্যাখ্যা, প্রেক্ষাপট বা রহিত কিনা ইত্যাদি দেখতে হবে, অথচ যখনই কুরআন বা হাদিসের কোন আয়াত তাদের মনমতো হয়, তখন কিন্তুু তারা এসব কোনকিছুই দেখে না। এটা কেমন ভন্ডামি?
যদিও কুরআনের ব্যাখ্যা ব্যাপারটাই কুরআনের সাথে সাংঘর্ষিক। ব্যাখ্যা হয় মানুষের গ্রন্থের, আল্লাহর স্পষ্ট কিতাবের ব্যাখ্যা মানুষ করবে, এটা রীতিমতো শিরক করা। তাছাড়া, কুরআনে একাধিকবার বলা আছে এটা নিজেই একটি সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা গ্রন্থ। যেমন:
১৬ নং সুরা নাহলের ৮৯ নং আয়াতে বলা আছে,
ؕ وَ نَزَّلۡنَا عَلَیۡكَ الۡكِتٰبَ تِبۡیَانًا لِّكُلِّ شَیۡءٍ وَّ هُدًی وَّ رَحۡمَۃً وَّ بُشۡرٰی لِلۡمُسۡلِمِیۡنَ
আমি তোমার প্রতি এ কিতাব নাযিল করেছি যা প্রত্যেকটি বিষয়ের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা, সত্য পথের নির্দেশ, রহমাত আর আত্মসমর্পণকারীদের জন্য সুসংবাদ স্বরূপ।
সুতরাং এর ব্যাখ্যা করার মাধ্যমে এই আয়াতগুলোকে অস্বীকার করা হয়। যদিও এটা ভিন্ন আলোচনা তাই এটা এখন স্কিপ করলাম।
২. এখন কথা হলো সঠিক অর্থ, ব্যাখা, প্রেক্ষাপট ইত্যাদি দিয়েও কি গোঁজামিল দেয়া বা ইসলামকে বাঁচানো সম্ভব? উত্তর হলো : না। তবে মনগড়া অর্থ ব্যাখ্যা এসব দিয়ে ইসলামকে বাঁচানো সম্ভব। মনগড়া অর্থ ব্যাখ্যা দিয়ে শুধু ইসলামকে নয়, যে কোন বই বা ধর্মগ্রন্থের ভুলকেই শুদ্ধ করা সম্ভব। ৯-৬ মিলিয়ে আপনি যে কোন জিনিসকেই মনমতো করে নিতে পারবেন।
এবার অর্থের ব্যাপারে আসি :
কুরআন বা হাদিস বা আরবি শব্দের বিভিন্ন অর্থ থাকে। মূলত এটা আরবি ভাষায় বেলায় নয়, যেকোনো শব্দের বেলায়ই শব্দের একাধিক বা বিভিন্ন অর্থ থাকে। এখন কথা হলো আমারা কি চাইলেই যেকোন অর্থ নিতে পারবো। না। কেননা, ভাষা পরিবর্তনশীল। একটি শব্দের তখন যেই অর্থ ছিল বর্তমানে সেই অর্থ নাও হতে পারে, ভাষার বিবর্তনের কারণে অর্থ ভিন্ন হতে পারে। এজন্য কুরআন হাদিস বা যে কোন বইয়ের অনুবাদের ক্ষেত্রে শব্দের সেই অর্থই নিতে হবে যে অর্থ সেই সময় প্রচলিত ছিলো।
উদাহরণসরূপ : রাজাকারের অর্থ সহযোগী যা খারাপ কিছু নয়, কিন্তু ৭১ এ জামাত কর্তৃক পাকি হানাদারদের বর্বরতায় সহযোগিতার কারণে রাজাকার মানে এখন দেশদ্রোহীর চেয়েও খারাপকিছু। অর্থাৎ ১০০ বছর পূর্বের একটি বাংলা বইকে ভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করতে গেলে রাজাকার শব্দটা তখন যেই অর্থে ব্যবহৃত হতো সেই অর্থই নিতে হবে। বর্তমান কোন অর্থ বা সেই সময়ের অপ্রচলিত বা ভিন্ন কোন অর্থ নেয়া যাবে না। খুবই সহজ হিসাব। তাছাড়া, কুরআনে বহুবার বলা আছে যে এটা খুবই সহজভাবে রচিত হয়েছে যেন তা সাধারণ মানুষের বোধগম্য হয়। এটা বলার কারণ হলো সাধারণ সাহিত্যিক বই অনেকের বোধ্যগম্য হয় না, কিন্তু এটা যেহেতু জীবনবিধান এবং সকল মানুষের জন্য তাই এটা সহজভাবে রচিত হয়েছে। সুতরাং কুরআনকে স্পষ্ট, কমন বা সে সময়ের প্রচলিত অর্থেই নিতে হবে। কিন্তুু জাকির নায়েকের মত কিছু মোডারেট মুমিনরা কুরআনকে বিজ্ঞানের সাথে মেলানোর জন্য অথবা মনে মতো অর্থ নেয়ার জন্য মনগড়া অর্থ নেয়, যেটি খুবই অযৌক্তিক। মনগড়া অর্থ নিয়ে আপনি শুধু কুরআনকেই নয়, রূপকথার গল্পের বইকেও বিজ্ঞানের সাথে মিলাতে পারবেন এবং নির্ভুল প্রমাণিত করতে পারবেন।
কুরআনের অর্থ বা রূপক অর্থ নিয়ে তারা আরেকটি গোঁজামিল দেয়ার চেষ্টা করে তা হলো : ৩নং সূরা ইমরানের ৭ নং আয়াত দিয়ে। যেমন :
هُوَ الَّذِیۡۤ اَنۡزَلَ عَلَیۡكَ الۡكِتٰبَ مِنۡهُ اٰیٰتٌ مُّحۡكَمٰتٌ هُنَّ اُمُّ الۡكِتٰبِ وَ اُخَرُ مُتَشٰبِهٰتٌ ؕ فَاَمَّا الَّذِیۡنَ فِیۡ قُلُوۡبِهِمۡ زَیۡغٌ فَیَتَّبِعُوۡنَ مَا تَشَابَهَ مِنۡهُ ابۡتِغَآءَ الۡفِتۡنَۃِ وَ ابۡتِغَآءَ تَاۡوِیۡلِهٖ ۚ وَ مَا یَعۡلَمُ تَاۡوِیۡلَهٗۤ اِلَّا اللّٰهُ ۘؔ وَ الرّٰسِخُوۡنَ فِی الۡعِلۡمِ یَقُوۡلُوۡنَ اٰمَنَّا بِهٖ ۙ كُلٌّ مِّنۡ عِنۡدِ رَبِّنَا ۚ وَ مَا یَذَّكَّرُ اِلَّاۤ اُولُوا الۡاَلۡبَابِ
তিনিই তোমার উপর কিতাব নাযিল করেছেন, তার মধ্যে আছে মুহকাম আয়াতসমূহ। সেগুলো কিতাবের মূল, আর অন্যগুলো মুতাশাবিহ। ফলে যাদের অন্তরে রয়েছে সত্যবিমুখ প্রবণতা, তারা ফিতনার উদ্দেশ্যে এবং ভুল ব্যাখ্যার অনুসন্ধানে মুতাশাবিহ্ আয়াতগুলোর পেছনে লেগে থাকে। অথচ আল্লাহ ছাড়া কেউ এর ব্যাখ্যা জানে না। আর যারা জ্ঞানে পরিপক্ক, তারা বলে, আমরা এগুলোর প্রতি ঈমান আনলাম, সবগুলো আমাদের রবের পক্ষ থেকে। আর বিবেক সম্পন্নরাই উপদেশ গ্রহণ করে। আল-বায়ান
কিন্তু তারা জানেই না এখানে সাধারণ আয়াতের কথা বলা হয়নি বরং হরফে মুকাত্তা’আত এর কোথা বলা হয়েছে। তাছাড়া, কুরআনে বহুবার বলা হয়েছে যে কুরআনকে সহজ করা হয়েছে। তার মধ্যে একটি আয়াত আমি উল্লেখ করছি : যেমন : ৫৪ নং সুরা ক্বমারের ২২ নম্বর আয়াত বলা আছে :
وَلَقَدْ يَسَّرْنَا الْقُرْآنَ لِلذِّكْرِ فَهَلْ مِن مُّدَّكِرٍ﴾
আমি কোরআনকে বোঝার জন্যে সহজ করে দিয়েছি। অতএব, কোন চিন্তাশীল আছে কি?
এমন আরো অসংখ্য আয়াত আছে আমি সবগুলো উল্লেখ করছি না।
সেই হিসেবে তো রূপক অর্থের আয়াতটি পরস্পরবিরোধী। কিন্তুু, না। এই আয়াতটি সাধারণ আয়াতের বেলায় নয়, বরং বিশেষ কিছু আয়াতের বেলায় যে বলা হয়েছে তা সহজেই বোঝা যায়। কারণ এসব আয়াতের অনুবাদই করা যাবে না, যেগুলোর অর্থ আল্লাহ এবং আর তার রাসুল ছাড়া কেউ জানে না। আর সেগুলো হলো হরফে মুতাকত্তিয়াত। অর্থাৎ সূরা ইমরানের ৬ নং আয়াতটি সাধারণ কোন আয়াতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
এবার আসি ব্যাখ্যার পালায় : কুরআন সম্পর্কে কার ব্যাখ্যা আমরা নিবো বা দেখবো? অবশ্যই নবী, সাহাবী, তাবেইন এবং তাবে তাবেইনদের ব্যাখ্যা দেখবো এবং সেগুলোই ইসলামের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা। কিন্তুু বর্তমানে জাকির নায়েকের মত কিছু মডারেট মুমিনরা সেইসব ব্যাখ্যা না নিয়ে মনগড়া ব্যাখ্যা করে। যার গ্রহণযোগ্যতা স্বয়ং ইসলামেই নেই। এই ধরনের ব্যাখ্যা হলো মনগড়া।
এবার আসি প্রেক্ষাপটে :
কুরআনের কোন আয়াত মন মত না হলে কুরআনের অমানবিক আয়াত গুলোর ক্ষেত্রে তারা গোঁজামিল দেয় যে এই আয়াত সেই যুগের প্রেক্ষাপটে প্রযোজ্য ছিলো, এখন প্রযোজ্য নয়। তাদের কাছে প্রশ্ন : কুরআন নির্দিষ্ট সময় বা প্রেক্ষাপটের জন্য নাকি সর্বকালের জন্য? তাছাড়া কুরআনের আয়াত যদি ওই সময়ের বা নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটে প্রযোজ্য হতো তাহলে তো কুরআন বা হাদিসেই বলা থাকতো। তাই না? হ্যাঁ, কুরআনের কিছু নির্দিষ্ট আয়াত আছে যেগুলো রহিত হয়ে তখনই নতুন আয়াত নাজিল হয়েছিলো, সেগুলো তো কোন প্রেক্ষাপটেই প্রযোজ্য না। কারণ সেগুলো বাতিল। কিন্তু মজার বিষয় হলো অধিকাংশ মুমিন জানেই না কুরআনের কোন আয়াতগুলো রহিত এবং সেগুলোর পরিবর্তে কোন আয়াতগুলো সংশোধনী নাযিল করা হয়েছিল। এজন্যই তারা কোন আয়াত মনমতো না হলেই সেটা না জেনেই রহিত বলে। অথচ তারা জানে না যে তাদের মনের মত আয়াত গুলোই আসলে মানসুখ বা রহিত। অন্যদিকে নাস্তিকরা যেই আয়াতগুলো দেখিয়ে ইসলামকে অমানবিক প্রমাণ করে সে আয়াতগুলো হচ্ছে নাসেখ বা রহিত আয়াতের পরিবর্তে নাযিল হওয়ার সংশোধনী আয়াত।
যেমন : ধর্মে জোরজবরদস্তি নেই বা তোমার ধর্ম তোমার কাছে আমার ধর্ম আমার কাছে। এটি একটি মানসুখ বা রহিত আয়াত।
আর হ্যাঁ, কুরআনের মানসুখ বা রহিত আয়াতগুলোর লিংক চিন্তার মুক্তি ইউটিউব চ্যানেলের ডিসক্রিপশন বক্সে দেয়া থাকবে। তারা মুমিন বা নাস্তিক সবাই পড়ে নিবেন।
মুমিনদের আরেকটি উল্লেখযোগ্য গোঁজামিল হলো : কুরআনের অমানবিক আয়াতগুলোর ক্ষেত্রে তারা বলে যেগুলো যুদ্ধের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অসম্পূর্ণ মিথ্যা এবং মনগড়া কথা। তারা না জেনে একদম আন্দাজে এই কথা বলে কারণ তারা কখনো শানে নুযুল বা ওই আয়াতগুলোর প্রেক্ষাপট পড়েনি। উদাহরণসরূপ : তারা সূরা তওবার প্রাথমিক যেই আক্রমাত্মক আয়াতগুলো আছে, সেগুলোর ক্ষেত্রে এই গোঁজামিলটা দেয়। অথচ তারা জানেই না যে সূরা তাওবা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নাযিল হয়নি। তাছাড়া, ইসলামে যুদ্ধের প্রেক্ষাপট ছাড়াই অমুসলিমদের উপর অতর্কিত এবং আআক্রমণাত্মক জিহাদের বিধান আছে।
যেমন : ইসলামিক ফাউন্ডেশন কতৃক প্রকাশিত সহিহ মুসলিম এর ৪৩৭০ নং হাদিসটি দেখি :
ইয়াহইয়া ইবনু ইয়াহইয়া তামীমী (রহঃ) … ইবনু আউন (রহঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বললেন, আমি নাফি’ (রহঃ) কে এই কথা জানতে চেয়ে পত্র লিখলাম যে, যুদ্ধের পূর্বে বিধর্মীদের প্রতি দ্বীনের দাওয়াত দেওয়া প্রয়োজন কি না? তিনি বলেন, তখন তিনি আমাকে লিখলেন যে, এ নিয়ম ইসলামের প্রারম্ভিক যুগে ছিল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনূ মুসতালিকের উপর আক্রমণ করলেন এমতাবস্থায় যে, তারা অপ্রস্তুত ছিল (তা জানতে পারেনি।) তাদের পশুদের পানি পান করানো হচ্ছিল। তখন তিনি তাদের যোদ্ধাদের (পূর্ণ বয়স্ক পুরুষ) হত্যা করলেন এবং অবশিষ্টদের (নারী শিশুদের) বন্দী করলেন। আর সেই দিনেই তাঁর হস্তগত হয়েছিল। (ইয়াহইয়া বলেন যে, আমার ধারণা হল, তিনি বলেছেন) জুওয়ায়রিয়া অথবা তিনি নিশ্চিতরূপে ইবনাতুল হারিছ (হারিছ কন্যা) বলেছিলেন। বর্ণনাকারী বলেন, এই হাদীস আমাকে আবদুল্লাহ ইবনু উমর (রাঃ) বর্ণনা করেছেন। তিনি সেই সেনাদলে ছিলেন।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
https://www.hadithbd.com/hadith/link/?id=13981
এই হাদিসে আমরা স্পষ্টভাবে দেখতে পাই এখানে কোন যুদ্ধ ছিলো না, বরং পাকিস্তানি হানাদারদের মতো অতর্কিত হামলা ছিলো এবং এও বলা হচ্ছে যে হামলার পূর্বে করার বিধানটি ইসলামের প্রারম্ভিক যুগে ছিলো। যা মুমিনদের তথাকথিত যুদ্ধের প্রেক্ষাপটের বিরুদ্ধে যায়।
সর্বশেষ বলতে চাই। ভুয়া ইসলাম এবং কুরআন হাদিসকে বাঁচাতে অর্থ ব্যাখ্যা প্রেক্ষাপটের নামে গোঁজামিল দিয়ে কোন লাভ নেই। একটু সময় নষ্ট হবে, কিন্তু ইসলাম ঠিকই ভুয়া প্রমাণিত হবে এবং ইসলামের লুঙ্গি আরো খুলে যাবে। তখন মুমিনরাই বলবে ভাই ব্যাখ্যা বা প্রেক্ষাপটে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। এখন তো তারা জানে না, তাই মনে করে ব্যাখ্যা এবং প্রেক্ষাপটে বুঝি ভালো কিছু আছে।