‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’ নামে কাজী কাদের নেওয়াজের একটা ব্যাকডেটেড কবিতা পড়ানো হয় বাংলাদেশের পাঠ্য বইয়ে। কবিতাটির সারসংক্ষেপ মোটামুটি এই :
মুঘল বাদশা আলমগীরের পুত্রকে পড়াতো দিল্লির এক মৌলভী। সুযোগ বুঝে মৌলভী মাঝেমাঝে শাহ্জাদাকে দিয়ে নিজের সেবা করিয়ে নিত। কোনো একদিন সে নিজের পা ধুচ্ছিল, আর পায়ে পানি ঢেলে দিচ্ছিল স্বয়ং শাহ্জাদা। এক সকালবেলা হঠাৎ বাদশার চোখে বিষয়টি ধরা পড়ে যায়। দরবারের খাসকামরায় ডাক পড়ে মৌলভীর। তখন তার আত্মারাম খাঁচাছাড়া। নির্ঘাত শাস্তি পেতে হবে ভেবে ধর্মীয় কিতাবে কোথায়-কী শিক্ষকের অধিকার লেখা আছে, তা বাদশাকে বোঝানোর প্রস্তুতি নিতে থাকে মৌলভী।
পরের দিন ভয়ে ভয়ে বাদশার নিকট গিয়ে হাজির হয় সে। গল্পের দই জমে ক্ষীর, যখন বাদশাহ্ মৌলভীকে বলে :
“নিজ হাতে যবে চরণ আপনি করেন প্রক্ষালন,
পুত্র আমার জল ঢালি শুধু ভিজাইছে ও চরণ।
নিজ হাতখানি আপনার পায়ে বুলাইয়া সযতনে
ধুয়ে দিল না’ক কেন সে চরণ, স্মরি ব্যথা পাই মনে।”
শিক্ষকের পায়ে শুধু পানি ঢালবে, নিজ হাতে পা ধুয়ে দেবে না—এ কেমন কথা! পুত্রকে আমার বেয়াদব বানাচ্ছেন কেন?
বাদশার তাজ্জব প্রশ্নে আর অপ্রত্যাশিত ভালোব্যবহারে মৌলভী আবেগাপ্লুত হলো।
শিক্ষককে যথাযোগ্য সম্মান করতে হবে—কবিতার মূল প্রতিপাদ্য যদি তাই হয়, তবে সে পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু এই কাহিনিকে বেশিরভাগ ইসলামপন্থী ধুরন্ধর শিক্ষক অপব্যবহার করে নিজের অপসুবিধা আদায় করতে চায়। বাদশার পোলা হইয়া হুজুরের পা ধুয়ে দেয়, তুই কোন্ নবাবজাদারে?—কোনো তালবেএলেম খেদমতের নামে হুজুরের কাজ করতে না চাইলে এভাবেই তাকে তিরস্কার করা হয়।
এক সময় হিন্দুধর্মেও গুরুগৃহ শিক্ষাপদ্ধতি চালু ছিল। গুরুর ঘর ঝাড়ু দেয়া, গরুছাগল হাঁসমুরগি পালা, গুরুকে রান্নাবাড়া করে খাওয়ানোসহ সব ধরনের কাজ করতো তার ছাত্ররা। বিনিময়ে গুরুর কাছ থেকে দীক্ষা পেত। ‘কাজের বিনিময়ে শিক্ষা’ বিষয়টি ছিল অনেকটা এমন। হিন্দুধর্মের বহু সংস্কারের ফলে এখন আর সেইদিন নেই। কিন্তু মুসলমানদের ইলমিঅঙ্গন এখনো এই শিক্ষাশ্রম থেকে পুরোপুরি মুক্ত হতে পারে নি।
বাংলাদেশের মাদ্রাসাশিক্ষাব্যবস্থায় “উস্তাদের খেদমত” নামে একটা টার্ম চাঙ্গা আছে। বিশেষকরে কওমি শিক্ষার্থীদের নোংরাভাবে কাজে লাগায় তাদের উস্তাদরা। হুজুরের বাসি লুঙ্গি কাচানো, এঁটো থালা ধুয়ে দেয়া, গায়ে তেল মালিশ করানো—গৃহপরিচারিকা বা ক্রীতদাসের মতো এমন কোনো কাজ নেই যা অল্প বয়সে বাবা-মাকে ছেড়ে আসা বাচ্চাদের দিয়ে করানো হয় না। নরম হাত দিয়ে উস্তাদের শরীর মাসাজ করতে বাধ্য করে কেউ কেউ। স্পর্শকাতর অঙ্গে হাত দিতে বাধ্য করা হয়। কোনো শিশু আপষে এ সবে রাজি না হলে তাকে অতিরিক্ত পড়া মুখস্থের টার্গেট দেয়া হয়। শিশুটিকে বশে আনার এটা টেকনিক মাত্র। পরদিন পড়া না পারলেই সজোরে উপুর্যুপরি বেতের বাড়ি। একএকটা কওমি মাদ্রাসা যেন একএকটা গুয়ান্তানামো বে কারাগারের ক্ষুদ্রসংস্করণ। হতভাগা এই শিশুদের পাঞ্জাবির নিচে লুকিয়ে থাকে লাল-লাল বড়বড় দাগ। যে শিশুরা আপোষে ‘উস্তাদের খেদমতে’ রাজি হয় তাদের অবশ্য নির্দয়ভাবে বেত মারা হয় না। তাদেরকে অন্যরকম ‘আদর’ করা হয়। এমন জঘন্য আদর কেউ শত্রুর ছেলের জন্যও প্রত্যাশা করে না, যদি সে মানুষ হয়।
বলাৎকারের শিকার এক মাদ্রাসাশিশুর সাক্ষাৎকার দেখছিলাম সেদিন। শিশুটি বলছিল, হুজুর প্রথমে তাকে শরীর “বানাইয়া” দিতে বলে। শরীর বানানোর পর হুজুরের আবদার :
“মোর নুনুডা একটু বানাইয়া দে। ওয়া দরলে কিচ্ছু অয় না। মোরা মাদ্রাসায় পড়ছি। সব হরছি। হুজুরেগো নুনু, ওয়া চুষিও।”
সবচেয়ে আশ্চর্য বিষয় হলো এই সব শিশুদের বাবা-মায়েরা জান্নাতের লোভে এতটাই লালায়িত থাকে যে সন্তানের ওপর অত্যাচার তারা দেখেও অদ্ভুত রকমের নীরব। পাছে হুজুরদের বদদোয়া লাগে। সন্তানকে আল্লাহর রাস্তায় একপ্রকার ‘কুরবানি’ দিয়েই তারা নিজেদের জান্নাত নিশ্চিত করতে আগ্রহী। অতিরিক্ত মার খেয়ে সন্তান পালিয়ে এলে পায়ে শিকল বেঁধে মাদ্রাসায় ফেরত পাঠায় অধিকাংশ বাবা-মা। এতিমখানায় এমন অনেক শিশুও পড়ে যাদের নালিশ জানানোর মতো কোনো অভিভাবকই নেই। ফলে হুজুর একেবারে ফাঁকা মাঠে গোল দেয়। এতিমরা এই অত্যাচারী উস্তাদদের কাছে জিম্মি।
এতিম শিশুরা বেশিরভাগ মাদ্রাসার সবচেয়ে বড় সম্পদ। তাদের সামনে রেখেই লিল্লাহবোর্ডিং-এর নামে টাকা তোলা হয়। কোনো কোনো মাদ্রাসার এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্ডিংয়ের মাসিক আয় কোটি টাকার বেশি। অথচ এতিমদের জন্য জোটে মরা আর কাঁকরসমৃদ্ধ মোটা চালের ভাত। তরকারি বলতে আলু, কম দামের কুমড়ো আর জলের চেয়ে পাতলা ডাল।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের আওতায় দেশের প্রতিটি থানায় যদি যথেষ্ট পরিমাণে ধর্মনিরপেক্ষ, বিজ্ঞানভিত্তিক, সর্বাধুনিক শিশুনিকেতন গড়ে ওঠে তবে সবচেয়ে কষ্ট পাবে দেশের মাদ্রাসা-ব্যবসায়ীরা। তাদের বিরাট এক ইনকামসোর্সের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর এই এতিম শিশুরা। কোনোভাবেই তাদের হাতছাড়া করতে চায় না তারা। ইনকাম বন্ধ হওয়ার আশঙ্কায় সরকারকে চাপ দিয়ে হলেও এটি কখনো হতে দেবে না কওমিসমাজ।
আবারও শিশুনির্যাতনের প্রসঙ্গে ফিরি। আমি মনে করি মাদ্রাসাঅঙ্গনেও কিছু হৃদয়বান মানুষ আছেন। তারা নিজেরাও ধর্মের ঐতিহাসিক দুষ্টচক্রের শিকার। কিন্তু তাদের হৃদয় পরিবর্তন-আকাঙ্ক্ষী। আপনাদের মুখ বন্ধ রাখার সুবিধা নিচ্ছে নষ্টরা। আপনারা কথা বলুন। শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হোন। শিশুরা শিখতে এসেছে, কারো শরীর “বানাইয়া” দিতে নয়। কারো বাসি লুঙ্গি কেচে দিতে নয়। কারো এঁটো থালা ধুয়ে দিতে নয়। কাউকে গেলমানীয় সুখ দিতে নয়। ছাত্রদের দিয়ে নিজের কাজ করিয়ে নিলে তাতে শিক্ষাগুরুর মর্যাদা বাড়ে না, বরং কমে। শিশুদের এক্সপ্লয়েট বন্ধ করুন। সম্মান শুধু শিক্ষকের একচ্ছত্র নয়, ছাত্রেরও আছে। শিশুদেরও ব্যক্তিত্ব আছে। আত্মসম্মানবোধ আছে। অভিমান আছে। মর্যাদা একপাক্ষিক নয়। একতরফা নয়। মর্যাদা পারস্পরিক দেয়ার-নেয়ার।
আবদুল্লাহ আল তারেক
১৫ অক্টোবর ২০২২