মৃত্যুর পর কি হবে?

জন্মের আগে যেমন ছিল মৃত্যুর পরও তেমনই হবে। জন্মের আগে আমরা কি আমাদের অস্তিত্বকে অনুভব করতে পারতাম? জন্মের আগে আমাদের কি সুখ বা দুঃখের অনুভূতি হত? নিশ্চয়ই না! ঠিক তেমনি মৃত্যুর পরেও আমরা আমাদের অস্তিত্বকে অনুভব করতে পারব না; কোন প্রকার সুখ-দুঃখের অনুভূতি আর থাকবে না।

কারণ মানুষের চিন্তাশক্তি এবং অনুভূতির উদ্ভব হয় মস্তিষ্কের ভিতরে থাকা নিউরোন এর অতিমাত্রায় জটিল পারস্পরিক আন্তঃসংযোগের মাধ্যমে। মানুষ যখন মারা যায়, তখন তার মস্তিষ্কেরও মৃত্যু ঘটে; মস্তিষ্কের বিনাশ অর্থাৎ অহমের বিনাশ। তাই শরীরের মৃত্যুর পর আর কোন তথাকথিত আত্মার অস্তিত্ব থাকতে পারে না।

“আমরা এটাও মনে করতে পারি না যে, দৈহিক মৃত্যুর পর একজন ব্যক্তির চিন্তা বেঁচে থাকতে পারে, যেহেতু মৃত্যু মস্তিষ্কের সংগঠনকে ধ্বংস করে এবং সেই শক্তিকে নষ্ট করে ফেলে যে শক্তি মস্তিষ্কের পথগুলিকে ব্যবহার করে থাকে।” — বার্ট্রান্ড রাসেল
আমাদের মৃতদেহটি তখন জড়পদার্থ ছাড়া কিছুই নয়; শত ক্ষতবিক্ষত, আগুনে দগ্ধ করলেও আমরা কোন প্রকারের সুখ-দুঃখ অনুভব করব না। আমাদের অস্তিত্ব প্রকৃতির চরম শূন্যতায় বিলীন হয়ে যাবে; অন্যদের কাছে আমরা হয়তো কিছু স্মৃতি হয়ে বেঁচে থাকবো। মূলত একজন মানুষ হচ্ছে মস্তিষ্কে সংরক্ষিত কিছু স্মৃতির সমষ্টি। স্মৃতি ধ্বংস হয়ে গেলে সেই মানুষটিরও কোন অস্তিত্ব থাকে না।

হুমায়ূন আজাদের ভাষায় —
❝মরে যাওয়ার পর কখনোই জানবো না যে আমি জন্ম নিয়েছিলাম, পৃথিবীতে ছিলাম। জন্মের আগে যেমন শূন্য ছিলাম, ম’রে যাওয়ার পর আমার কাছে আমি সম্পূর্ণ শূন্য হয়ে যাবো। আমার সূচনার আগের অধ্যায় অন্ধকার, সমাপ্তির পরের পরিচ্ছদও অন্ধকার। দুই অন্ধকারের মধ্যে ক্ষণিক আলোর ঝিলিক আমি।❞

কিন্তু মৃত্যু মানে জীবনের সমাপ্তি ; এরপর আর কিছু আছে? নাকি নাই? এমন দ্বন্দ্ব আর অপ্রত্যক্ষনুভূতি থেকে আসে ভয়। এরপর আর কিছুই নেই এটা মানুষ মেনে নিতে পারে না এবং এর ফলে তৈরি হয় হতাশা। মৃত্যুর পরে সত্যি কি কিছু আছে? এমন প্রশ্নের প্রমাণসিদ্ধ কোন যৌক্তিক উত্তর খুঁজে না পেয়ে ভীতসন্ত্রস্ত আদিম মানুষের মনে সৃষ্টি হয়েছিল অস্বস্তিকর শূন্যতা। আর তাই মানুষ, সেই শূন্যতাকে স্বর্গ-নরক, জান্নাত-জাহান্নাম, পুনর্জন্ম, মুক্তি, নির্বাণ এই ধরনের নানা কল্পিত বিশ্বাস দিয়ে পূর্ণ করেছিল ভয়, হতাশা আর সেই অস্বস্তিকর শূন্যতা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য। অবশেষে অপ-বিশ্বাসের আফিম গ্রহণ করে মানুষ যেন স্বস্তি পেল।

❝যদি আমরা মৃত্যুকে ভয় না পেতাম, তাহলে আমি বিশ্বাস করি না যে কখনও অমরত্বের ধারণা গড়ে উঠতে পারত।❞
— বার্ট্রান্ড রাসেল

এমন হতাশায় সাধারণ মানুষই কেবল ভারাকান্ত হয় তেমন নয়; অনেক দার্শনিক, বিজ্ঞানী, মনীষীও সমাপ্তির বেদনায় হতাশাগ্রস্ত। কিন্তু তবুও তাদের মধ্যে অনেকে বাস্তবতা মেনে নেয়। কোন ধরনের অলীক কল্পনা বা বিশ্বাসের আশ্রয় গ্রহণ করে নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা তারা করেন না। অন্তিম পরিণতির মুখোমুখি হওয়ার জন্য তাদের কোন আফিমের প্রয়োজন নেই।

জ্যোতির্বিজ্ঞানী কার্ল সেগান এর উক্তি প্রণিধানযোগ্য, ❝আমি এটা বিশ্বাস করতে পারলে খুশি হতাম যে, মৃত্যুর পর আমি আবার বেঁচে উঠবো। আমার চিন্তা, অনুভূতি, স্মৃতি ইত্যাদি আমার মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকবে। কিন্তু সারা পৃথিবী জুড়ে আমাদের সংস্কৃতিতে মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের আদি বিশ্বাস সত্ত্বেও যখনই আমি তা বিশ্বাস করতে প্রলুব্ধ হই, তখনই মনে পড়ে যে, এটা আমার স্বপ্নীল ইচ্ছার ধূসর মরীচিকা ছাড়া কিছুই নয়।❞

বার্ট্রান্ড রাসেলের মতো আমিও বিশ্বাস করি, মানুষ যখন মরে যায়, সে “মৃত ব্যক্তি”। তারপর তার আর জীবন নেই, থাকতেও পারে না। সোজা কথায় মৃত্যুর পর আর কিছুই হবে না। মৃত্যুর পর আর কোন অধ্যায়ের আরম্ভ নাই। স্বর্গ নেই, নরক নেই, নেই কোন মুক্তি, নির্বান, নেই কোন পুনর্জন্ম জন্ম; কিছুই নেই। এই সব মনভুলানো কথা বিশ্বাস করে নিজেকে ধোঁকা দেওয়ার চাইতে বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়ায় যুক্তিযুক্ত।

❝আমি বিশ্বাস করি, যখন আমি মরব তখন আমি পঁচব এবং আমার কোন রকম অহঙ্কারই বেঁচে থাকবে না। আমি জীবনকে ভালবাসি। কিন্তু মহাপ্রলয়ের ভয়াবহতার কথা চিন্তা করে ভয়ে কাঁপাটাকে আমার অবশ্যই ঘৃণা করা উচিৎ। ❞
— বার্ট্রান্ড রাসেল

তবুও কেউ যদি অপ-বিশ্বাসের উপর জোর দিতে চাই, তবে আমার জবাব; এই সব বিশ্বাসের সত্যতা যাচাই করা বা কোন ভাবে প্রমাণ করা অসম্ভব। অনুভব করাও অসম্ভব। কোন মৃত ব্যাক্তি স্বর্গ বা নরক থেকে এসে আমাদের কাছে মৃত্যু পরবর্তী সময় নিয়ে বর্ণনা করে যাবে না। আবার কেউ এমনটা দাবি করলে সেটাও প্রমাণ করা, যাচাই-বাছাই করার অযোগ্য। মৃত্যুর পরে যদি কিছু থেকেও থাকে, সেটা বিশ্বাসীদের পক্ষে প্রমাণ করা সম্ভব হয়নি। অথচ এমন দাবি প্রমাণযোগ্য না হওয়া সত্ত্বেও বিশ্বাসীরা সেগুলোতে বিশ্বাস স্থাপন করে। কিন্তু সেইসব তথ্যই আমরা নিরাপদে গ্রহণ করতে পারি; যেগুলিকে অবশ্যই প্রমাণ প্রদর্শন বা যাচাই-এর যোগ্য হতে পারে।

❝আমরা সবাই জানি যে মস্তিষ্কে আঘাত লাগলে স্মৃতি ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। একজন ধার্মিক মানুষ এনসেফালাইটিস লেথারজিকার কবলে পড়ে লম্পট মানুষে পরিনত হতে পারে এবং আয়োডিনের অভাবে একটি বুদ্ধিমান বালক বোকায় পরিণত হতে পারে। এই ধরনের অতিপরিচিত ঘটনাগুলির উপর চোখ রেখে এটা অসম্ভব বলে মনে হয় যে মৃত্যুর পর মস্তিষ্ক কাঠামোর সম্পূর্ণ ধ্বংসের পরও মন জীবিত থাকে।❞
— বার্ট্রান্ড রাসেল

সেই সব দাবি অন্ধ বিশ্বাস করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। অন্ধভাবে বিশ্বাসই যখন করতে হবে, তাহলে যে কোন কিছু বিশ্বাস করতে মানুষের বাঁধা কোথায়? মানুষ যে কোন কিছুই কল্পনা করতে পারে, বিশ্বাস করতে পারে। তাইতো পৃথিবীর নানা প্রান্তে, নানা বিশ্বাসের আফিমে মানুষ আসক্ত। একজন বিশ্বাসী কোন যৌক্তিক কারন ছাড়াই যেকোনো কিছু বিশ্বাস করতে পারে এবং তা আকড়ে ধরে রাখতে সক্ষম। কিন্তু কোন যৌক্তিক কারন ছাড়াই কোন কিছুকে বিশ্বাস করা নিজেকে নিজেই ধোঁকা দেওয়ার মতো।

পূর্বে যেমন বলেছি, আমরা সবাই অস্তিত্বহীন হওয়ার লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছি। “শরীর থেকে পৃথক কোন চৈতন্য নেই।” দেহাতীত কোন আত্মা নেই।”(চার্বাক দর্শন) এই কঠিন সত্যকে সবাই মেনে নিতে পারেনা, অস্বস্তিতে ভোগেন; অধিকাংশ মানুষ বাস্তবতার মুখোমুখি হতে অক্ষম; তারা নিজেকে ধোঁকা দিতেই অধিক সাচ্ছন্দ্য বোধ করে। নিজেকে কল্পিত বিশ্বাসের অন্ধকারে ডুবিয়ে রাখতে ভালোবাসেন। আবার নগন্য কিছু ব্যাতিক্রমী মানুষ আছেন যারা অপ-বিশ্বাসের সীমারেখার বাহিরে গিয়ে মৃত্যুকে একটু ভিন্নভাবে দেখার চেষ্টা করেন; তাতে নিশ্চয় দোষের কিছু নেই। আমাদের সীমার মধ্যে আমরা যতদূর অবধি জানতে পারি তা দিয়েই আমাদের থামতে হয়।

মৃত্যুকে তুচ্ছ করা মার্ক টোয়াইন,

❝আমি মৃত্যুকে ভয় পাই না, আমার জন্মের আগে, হাজার কোটি বছর ধরে আমি মৃতই ছিলাম এবং সেজন্য সামান্যতম কোন অসুবিধা আমার হয়নি❞ — মার্ক টোয়েইন

❝মানুষ কিভাবে মৃত্যুর পরেও বেঁচে ওঠে তা কোনভাবেই বিশ্বাসযোগ্য নয়, যদিও ভয় পেয়ে বা ধর্মীয় অহংবোধের বশবর্তী হয়ে দুর্বলচিত্ত মানুষ তাও বিশ্বাস করে।❞
— আলবার্ট আইনস্টাইন

❝পৃথিবী এতটাই অপরুপ, প্রেম আর নৈতিকতার সাগর এতটাই গভীর যে আমাদের সে সমস্ত সুন্দর গল্প দিয়ে প্রতারিত হওয়ার কোন প্রয়োজন নেই, যেগুলোর মধ্যে অল্পই বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ রয়েছে। আমার কাছে এ সমস্ত গল্পের চেয়ে ভালো মনে হয় মৃত্যুর চোখের দিকে তাকিয়ে থেকেও প্রতিটি অতিরিক্ত দিনের জন্য কৃতজ্ঞ হওয়া। জীবন সংক্ষিপ্ত হলেও তার মহৎ সুযোগের জন্য ধন্যবাদ দেওয়া।❞
— কার্ল সেগান

তথ্যসূত্র :
১. বার্ট্রান্ড রাসেল রচনা সমগ্র-১, পৃষ্ঠাঃ ৬২
২. বার্ট্রান্ড রাসেল রচনা সমগ্র-১, পৃষ্ঠাঃ ৬৫
৩. বার্ট্রান্ড রাসেল রচনা সমগ্র-১, পৃষ্ঠাঃ ৬৬
৪. রচনা সমগ্র-১, পৃষ্ঠাঃ ৯৯

  • Shimul Chowdhury

Related Posts

পরকাল নিয়ে মুমিনদের বহুল জিজ্ঞেসিত প্রশ্নের জবাব

প্রশ্ন : পরকাল না থাকলে যেসব অপরাধীদের দুনিয়াতে উপযুক্ত শাস্তি দেয়া সম্ভব হচ্ছে না তাদের বিচার কিভাবে হবে? জবাব : ১. আপাততদৃষ্টিতে যদিও আমরা ধরে নিই যে পরকাল থাকলে আসলেই অপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত হতো এবং খুব ভালো হতো, তার মানে কি এই যে পরকাল আছে বা পরকাল সত্য? অর্থাৎ কোনকিছু হলে বা থাকলে ভালো হতো, তার মানে তো এই নয় যে সেটা সত্য বা আছে। উদাহরণসরূপ : আপনি…

Read more

ধর্ম না থাকলে মানুষ নৈতিকতা শেখবে কোথা থেকে? 

ধরুন, একজন আধুনিক সভ্য মানুষ হিসেবে আপনার কাছে অবশ্যই যুদ্ধবন্দী নারীকে গনিমতের মাল হিসেবে বিছানায় নেয়া খুবই নিন্দনীয় কাজ বলে গণ্য হবে। কিন্তু এই কাজটি আপনার নবীজী নিজ জীবনে কয়েকবারই করেছেন, এবং অন্যদেরও করতে বলেছেন। বা ধরুন আপনি এমন কারও সাথে আপনার বোন বা কন্যাকে বিয়ে দেবেন না, যার ইতিমধ্যে তিনজন স্ত্রী আছে। আপনার বিবেক, বুদ্ধি, আধুনিক মূল্যবোধ, আধুনিক ধ্যান ধারণা আপনাকে সেইসব মধ্যযুগীয় কাজ করতে বাধা দেবে। যদিও…

Read more

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Latest

আমাদের জাতীয় সঙ্গীত কি হিন্দু শাক্তদেবী মা-কালীকে উদ্দেশ্য করে লেখা?

আমাদের জাতীয় সঙ্গীত কি হিন্দু শাক্তদেবী মা-কালীকে উদ্দেশ্য করে লেখা?

একেই কি বলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা?

একেই কি বলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা?

কর্ণচিকিৎসা

কর্ণচিকিৎসা

তাকদীর বিষয়ক রেফারেন্স

তাকদীর বিষয়ক রেফারেন্স
কুদরত

পরকাল নিয়ে মুমিনদের বহুল জিজ্ঞেসিত প্রশ্নের জবাব

পরকাল নিয়ে মুমিনদের বহুল জিজ্ঞেসিত প্রশ্নের জবাব