“কুসংস্কারাচ্ছন্ন অযৌক্তিক চিন্তা-ভাবনা, কথাবার্তা ও কাজকর্ম থেকে রক্ষা পেতে ‘কুযুক্তি’ সম্পর্কে ধারনা রাখুন।
যৌক্তিক ও কুসংস্কারমুক্ত মানুষ হোন, সভ্যতার অগ্রগতিতে অবদান রাখুন।”
বিষয় : যুক্তিবিদ্যা (Logics)
অধ্যায় : কুযুক্তি বা Logical Fallacy
ভূমিকা :
গণিত বিষয়ক জ্ঞান যেমন প্রত্যেকের থাকা উচিত, তেমনি যুক্তিবিদ্যা বিষয়ক জ্ঞানও প্রত্যেকের থাকা উচিত। ৫ + ২ = ৭ এটি সব সুস্থ মানুষই মেনে নেয়। সম্পূর্ণ বা আংশিক অসুস্থ অথবা ভন্ড মানুষ যারা তারা হয়ত মানে না যে, ৫ + ২ = ৭ হয়। অথবা তারা অপ্রয়োজনীয় এমন কথাবার্তা (ত্যানাবাজী) করে যে, বোঝা যায় না – তারা কি এটা মেনে নিল নাকি মানল না? কুযুক্তিগুলোকে কুযুক্তি হিসাবে না মানলে তাকেও সুস্থ মানুষ বলা হয় না। ইন্টারনেট বা অনলাইনে গুগল সার্চের মাধ্যমে বা অন্য সার্চ ইঞ্জিনের মাধ্যমে “কুযুক্তি” বা “Logical Fallacy” সম্পর্কে সহজেই জানা যায়। আবার www. google translate.com ব্যবহার করে সহজেই যেকোনো ভাষা থেকে অন্য যেকোনো ভাষায় অনুবাদ করা যায়।
যুক্তি ও প্রমাণ মানুষের জীবনে অতি গুরুত্বপূর্ণ। আদালতের ন্যায় বিচারক হওয়ার জন্য বা আমাদের যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য Logical fallacy (কুযুক্তি বা কুতর্ক বা হেত্বাভাস) বিষয়ক ধারনা আবশ্যক। শুরুতেই কুযুক্তি /কুতর্ক / হেত্বাভাস Logical fallacy কাকে বলে, তা ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। এর মানে হচ্ছে, প্রতারণামূলক কিছু, কুতর্ বা কুযুক্তি অথবা ন্যায় কর্মে ফাঁকি দেয়া। যুক্তিবিদ্যায় প্রচলিত কিছু অনর্থক কথার মারপ্যাঁচ কিংবা ভুলযুক্তি/কুযুক্তি/অপযুক্তি বা কুতর্ক জুড়ে দেয়ার প্রবণতা দীর্ঘদিন ধরে লক্ষ্যণীয় ছিল, এবং এগুলো সবই যে কুযুক্তি তা দ্বিধাহীনভাবেই প্রমাণিত হয়েছে। তাই বর্তমান সময়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে, বিতর্ক বা একাডেমিক আলোচনার সময় নির্ধারিত কিছু কিছু যুক্তিকে কুযুক্তি বা হেত্বাভাস বা logical fallacy হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
সভ্য মানুষ হতে হলে অবশ্যই জানতে হবে, কুযুক্তি বা লজিক্যাল ফ্যালাসি কাকে বলে, ইহা কত প্রকার এবং কী কী। এই আলোচনা সম্পূর্ণটুকুই আন্তর্জাতিক যুক্তিবিদ্যা বিষয়ক নানা বই থেকে সংগৃহীত। পৃথিবীর উন্নত দেশসমূহের প্রায় সকল যুক্তিবাদী মানুষই বিষয়গুলো সম্পর্কে অবগত। অনুন্নত, অসভ্য এবং অশিক্ষিত সমাজে যদিও এই কুযুক্তিগুলোই এখনো যুক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। কিন্তু এগুলোর কোনটাই আসলে যুক্তি হিসেবে গণ্য হয় না। সহজভাবে বলতে গেলে, এই ধরণের কুযুক্তিগুলোর সবই যুক্তিবিদ্যার শুরুতেই বাতিল করে দেয়া হয়। সেগুলো আলোচনাতে আসবার যোগ্যতাই রাখে না। সভ্য মানুষ হওয়ার জন্য আপনি যুক্তিবিদ্যা সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে থাকলে, এই লেখাটি সবার আগে মন দিয়ে পড়ে নেয়া জরুরি। কারণ, হয়তো আপনি নিজেই মনের অজান্তে মানুষকে নানা ধরণের কুযুক্তি বা ফ্যালাসি দিয়ে যাচ্ছেন।
কুযুক্তি বা লজিক্যাল ফ্যালাসি হচ্ছে যুক্তির ভান করে আপনাকে মিথ্যা বা অযৌক্তিক কিছু বোঝাবার কৌশল। যুক্তি প্রদানের প্রধান বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিত, সততার সাথে যুক্তি দেয়া এবং আপনার যুক্তি ভুল হয়ে থাকলে অন্যের শুদ্ধটি দ্বারা তা শুধরে নেয়া। মূর্খের মতো অসৎভাবে যারা যুক্তি প্রদান করে বা চালাকিপূর্ণ যুক্তি তুলে ধরে, তাদের থেকে সাবধান থাকা প্রত্যেক সভ্য মানুষের জন্য খুবই জরুরি। কারণ, তারা আপনাকে অযৌক্তিক বা চালাকিপূর্ণ যুক্তি দেখিয়ে আপনার মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে খাবে। এই ধরণের প্রতারণামূলক যুক্তিগুলো বিশ্লেষণ করে, সেগুলো বাতিল করে সঠিকভাবে গঠনমূলক যুক্তি কিভাবে প্রদান করতে হয় তা শিখতে হলে কুযুক্তি বা লজিক্যাল ফ্যালাসি সম্পর্কে সবারই অবশ্যই জানা থাকা উচিত। আলোচনায় উল্লেখিত উদাহরণগুলোর মধ্যে প্রায় সকল উদাহরণ এমন ধর্মীয় উদাহরণ হিসাবে দেয়া হয়েছে যাতে তা সাধাারণ মানুষের সহজে বোধগম্য হয়।
১. চক্রাকার কুযুক্তি (Circular Logic Fallacy) :
প্রশ্ন-১: হিন্দু ধর্মের বই বেদ যে সত্য তার প্রমাণ কী?
কুযুক্তি দাবী -১: বেদ সত্য কারণ ভগবান বলেছেন বেদ সত্য।
প্রশ্ন-২: ভগবান যে সত্য তার প্রমাণ কী?
কুযুক্তি দাবী -২: ভগবান সত্য কারণ বেদে লেখা আছে ভগবান সত্য।
উপরের দাবী দুটো লক্ষ্য করলে দেখা যায়, একটি দাবী আরেকটি দাবীকে সত্য প্রমাণ করতে চাচ্ছে। এই দাবী দুটো একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল। এর কোনটাই প্রমাণিত নয়, তবে একটি আরেকটি দাবীর প্রমাণ হিসেবে সাক্ষ্য দিচ্ছে। যুক্তিবিদ্যায় একে বলে চক্রাকার যুক্তি বা সার্কুলার লজিক। এটি একটি কুযুক্তি।
২. অপ্রমাণের বোঝা কুযুক্তি (Burden of Proof Fallacy) :
ঘটনা- ১
দাবীঃ ইউরেনাস গ্রহে আমার দাদার একটি দোতলা দালান আছে।
প্রশ্নঃ ইউরেনাস গ্রহে তোমার দাদার একটি দোতলা দালান আছে, তার প্রমাণ কী?
কুযুক্তিঃ ইউরেনাস গ্রহে আমার দাদার একটি দোতলা দালান নেই, তা তুমি প্রমাণ করতে পারবে?
ঘটনা-২
দাবীঃ স্যুপারম্যানের সাথে আমার প্রতিদিন কথা হয়।
প্রশ্নঃ স্যুপারম্যান যে আছে তার প্রমাণ কী?
কুযুক্তিঃ স্যুপারম্যান নেই, তা প্রমাণ করতে পারবে?
উপরের প্রতিটি দাবী এবং দাবীর সপক্ষে কুযুক্তিগুলো লক্ষ্য করুন। দাবীকারী নিজ দাবীর সপক্ষে কোন প্রমাণ উপস্থাপন না করে বরং প্রশ্নকর্তাকেই তার দাবীটি অপ্রমাণের দাবী জানাচ্ছে। অর্থাৎ, তার কাছে তার দাবী প্রমাণের যথেষ্ট যুক্তি না থাকায় প্রশ্নকর্তার ওপরেই সে তার দাবী অপ্রমাণের বোঝা চাপাতে চাচ্ছে। যুক্তিবিদ্যায় একে বলা হয় অপ্রমাণের বোঝা কুযুক্তি। উল্লেখ্য, প্রমাণ বা যুক্তি উপস্থাপনের দায় তারই, যিনি দাবী উত্থাপন করেন। অন্য কারও তা প্রমাণ বা অপ্রমাণ করার দায় নেই। অন্য কেউ কারো দাবী অপ্রমাণ না করলেও, কারো দাবী প্রমাণের বোঝা অন্যের কাঁধে চাপাতে চাইলে উপযুক্ত তথ্য প্রমাণ ও যুক্তির অভাবে তার দাবীটিই খারিজ বা বাতিল হয়ে যাবে।
৩. অজ্ঞতার কুযুক্তি (Argument from Ignorance Fallacy) :
দাবীঃ যেহেতু তুমি জানো না, আমার মাথায় কতগুলো চুল আছে; তাই হিন্দু ধর্মের দেবতা ব্রহ্ম হলেন সৃষ্টিকর্তা।
দাবীঃ যেহেতু তুমি জানো না, মিশরের পিরামিডগুলো কোনটি কয়টি পাথর দিয়ে বানানো; তাই যৌন সম্পর্ক ছাড়াই যিশু খ্রিস্টের মা ম্যারীর গর্ভে সন্তান হয়েছে।
দাবীঃ যেহেতু তুমি জানো না, মহাবিশ্বে কতগুলো গ্রহ, নক্ষত্র, ধূমকেতু ইত্যাদি আছে; তাই মুহাম্মদ ঘোড়ায় চড়ে সাত আসমান পাড়ি দিয়ে কয়েক মিনিটেই আবার পৃথিবীতে ফিরে এসেছেন।
দাবীঃ যেহেতু তুমি জানো না, প্রশান্ত মহাসাগরে কত লিটার পানি আছে; তাই হনুমান এক লাফে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ভারত থেকে শ্রীলঙ্কা পৌঁছে গেছে।
দাবীঃ যেহেতু কেউ জানে না, আমার ভাইয়ের খুনী কে; তাই হারুন মিয়াই আমার ভাইকে খুন করেছে।
উপরের দাবীগুলো অজ্ঞতার কুযুক্তির কিছু উদাহরণ। ধরুন, কেউ দাবী করলো, তিনিই মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন; এবং যুক্তি হিসেবে উপস্থাপন করলো, এই দাবীটি কেউ অপ্রমাণ করতে পারবে না, এবং আরও প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করলো মানুষের অজ্ঞতাকে। যেহেতু পৃথিবীর মানুষ কিছু বিষয় সম্পর্কে এখনও জানে না; বা দাবী উপস্থাপনকারীর ঐ কথাটি এখনও কেউ ভুল প্রমাণ করেনি; সেহেতু তার দাবীটিই সঠিক, এমন যুক্তি দেখানো হলো একটি কুযুক্তি। এটাকে অজ্ঞতার কুযুক্তি বলে।
আগুন সম্পর্কে না জানার কারণে মানুষ প্রাচীনকালে আগুনের পূজা করত। পরবর্তীতে আগুন সম্পর্কে জানার কারণে আগুনকে ভয় করে পূজা করা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। পৃথিবীর মানুষের এখনও কিছু কিছু বিষয় অজানা আছে। মানুষ অজানাকে জানার চেষ্টা করতে পারে। ধীরে ধীরে জানাও সম্ভব হচ্ছে। তথ্য প্রমাণ এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে। কিন্তু আমাদের কোন অজানা বিষয় থাকার অর্থ এই নয় যে, অমুকের দাবীটি সঠিক। যেকোন অজানা বিষয়কে জানার পদ্ধতি হচ্ছে, তা নিয়ে পড়ালেখা করা, বৈজ্ঞানিক গবেষণা, তথ্য প্রমাণ যুক্তি দিয়ে জানার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। অমুকে সৃষ্টি করেছে বা তমুকে এমনটি ঘটিয়েছে তা ধরে নেয়া নয়। কোনো অজানা বিষয় অপ্রমাণিত কোনো কিছুর সপক্ষের যুক্তি বা প্রমাণ হতে পারে না। এটাকে অজ্ঞতার কুযুক্তি বলে।
৪. প্রকৃতিগত কুযুক্তি (Appeal to Nature Fallacy) :
এই কুযুক্তিটির গতানুগতিক ব্যবহারটি লক্ষ্য করা যায় যখন “ভাল” এর সংজ্ঞা দেবার চেষ্টা করা হয়। দার্শনিক জি. ই. মুর (১৮৭৩-১৯৫৮) যুক্তি দেন, কোন কিছু প্রাকৃতিক বলে একে “ভাল” বা “নৈতিক” বলে সংজ্ঞায়িত করলে ভুল হবে। এই হেত্বাভাসে প্রকৃতি বা প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের সাথে ভাল মন্দের সম্পর্ক স্থাপন করার চেষ্টা করা হয় বলেই এর নাম “ন্যাচারালিস্টিক ফ্যালাসি”।
উদাহরণ:
প্রস্তাবঃ প্রাকৃতিকভাবে যেহেতু নারী পুরুষের বৈশিষ্ট্য আলাদা তাই নারী পুরুষকে সমান মনে করা বা সমান অধিকাট দেয়া খারাপ।
কিন্তু, প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে ধরে নিয়ে কোন কিছুকে যদি নৈতিক বা ভাল মনে করা হয়, তাহলে একই যুক্তিতে প্রকৃতি মানুষকে অসুখবিসুখ এবং রোগব্যাধি দেয়। তাই একই যুক্তিতে ধরে নিতে হয়, অসুখ বিসুখ যেহেতু প্রাকৃতিক তাই নৈতিক এবং ভাল। এবং ঔষধের দ্বারা প্রকৃতির কাজে বাঁধা দেয়া এবং অসুস্থের চিকিৎসা করা নৈতিকভাবে ভুল। তাই বোঝা যাচ্ছে, প্রাকৃতক বা স্বাভাবিক বলেই কোন কিছু নৈতিক এবং ভাল, তা বলা যায় না।
আবার ধরুন, রাস্তাঘাট নির্মান, বিমান গাড়ি চালানো, এগুলো কোনটাই প্রাকৃতিক নয়। বরঞ্চ প্রকৃতির বিরুদ্ধে গিয়েই রাস্তাঘাট বানাতে হয়, বিমান গাড়ি ইত্যাদি চালাতে হয়। তাই প্রাকৃতিক তাই ভাল বা নৈতিক, এমনটা দাবী করা একটি কুযুক্তি বা ফ্যালাসি বা লজিক্যাল ফ্যালাসি।
৫. স্বাভাবিক করার আবেদন (Appeal to Normality Fallacy) :
অর্থাৎ, প্রথা / অধিকাংশ মানুষ করতো বা করে এই দোহাই দিয়ে কোন অপরাধকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা। এই কুযুক্তিটি সংঘটিত হয় যখন কী স্বাভাবিক, কী স্বাভাবিক নয়, কী হয়ে আসছে, কী কখনও হয় নি, এর উপর ভিত্তি করে যখন কোন নৈতিক সিদ্ধান্ত টানা হয়, কোনোটাকে ভাল, কোনোটাকে মন্দ বলা হয়। অন্যভাবে বললে, সচরাচর ঘটে কিংবা সচরাচর ঘটে না, সবাই করে কিংবা সবাই করে না, এর ওপর ভিত্তি করে যদি কোন কাজকে নৈতিক/ভাল বা অনৈতিক/মন্দ কাজ বলে সিদ্ধান্ত টানা হয়, তাহলে তাকে আপিল টু নরমালিটি ফ্যালাসি বলা হবে।
উদাহরণ:
১। দাবীঃ “১৪০০ বছর আগে পরাজিত বাহিনীর লোকদের হত্যা করে তাদের স্ত্রী ও কন্যাদের তুলে এনে গনিমতের মাল নাম দিয়ে তাদের সাথে যৌন সম্পর্ক করাটাই স্বাভাবিক ছিল। তাই এই কাজকে খারাপ বলা যাবে না।“
কিন্তু ১৪০০ বছর আগে কোনো কাজ খুবই স্বাভাবিক ছিল, সকলেই করতো, সেই কারণেই তা নৈতিক বা ভাল কাজ বলে গণ্য হতে পারে না।
২। দাবীঃ “বাংলাদেশে বেশিরভাগ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিই ঘুষ খায়। তাই ঘুষ খাওয়ায় খারাপ কিছু নেই।“
কিন্তু বেশিরভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারি ঘুষ খেলেই, দুর্নীতি করলেই দুর্নীতি করা বৈধ বা নৈতিক বা ভাল কাজ বলে গণ্য হতে পারে না।
৩। দাবীঃ “বাংলাদেশে তারেক জিয়া দুর্নীতি সৃষ্টি করেন নাই। তার আগেও দুর্নীতি হতো। তারেক জিয়ার আগে আওয়ামী লীগও দুর্নীতি করেছে। দুর্নীতিই বাংলাদেশের মত দেশে এই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাভাবিক বিষয়। সবাই করে। পুলিশ, আমলা, কর্মচারী, কর্মকর্তা সকলেই। তাহলে তারেক জিয়া করে কী অপরাধ করেছে?“
কিন্তু তারেক জিয়া দুর্নীতি সৃষ্টি করে নি, তার আগেও দুর্নীতি হতো, সকলেই করতো, সেটাই সেই সময়ে স্বাভাবিক ছিল, এগুলো কোনটাই দুর্নীতিকে ন্যায্যতা দান করে না। দুর্নীতি করা, জনগণের কষ্টার্জিত অর্থ লুট করা খারাপ এবং সকলে করলেও সেটা খারাপই থাকে। সকলেই করতো – এই দোহাই দিয়ে কাজটিকে ভাল কাজ বলে প্রমাণ করা যায় না।
৪। দাবীঃ “হযরত মুহাম্মদ ৬ বছরের আয়শাকে বিয়ে করে ৯ বছরে বৈবাহিক যৌনজীবন শুরু করেন। ঐ সময়ে এটাই ছিল স্বাভাবিক। সকলেই করতো। আওয়্যামে জাহিলিয়াতের যুগেও এটির প্রচলন ছিল। তাই নবী মুহাম্মদ কোন খারাপ কাজ করেন নি।“
কিন্তু ঐ সময়ে সকলে করে থাকলেও, সকলের কাজই খারাপ কাজ বলে গণ্য হবে। সকলে করতো তাই একজনার কোন অসভ্য খারাপ কাজকে ভাল কাজ আমরা বলতে পারি না। সকলে করলেও একটি খারাপ কাজ খারাপই থাকে। এক্ষেত্রে মুহাম্মদকে সর্বকালের অনুসরণীয় আদর্শ মানব বলা একটি কুযুক্তি।
৫। দাবীঃ “আমাদের গ্রামে অধিকাংশ নারীরই বাল্যবিবাহ হচ্ছে, এটা এখানে একটা নরমাল ব্যাপার, সুতরাং এটায় ক্ষতির কিছু নেই।“
উপরের একই কারণে এটি কুযুক্তি।
৬. সহিহ (খাঁটি) স্কটসম্যান নহেন কুযুক্তি (No True Scotsman Fallacy) :
এটি আরেকটি বহুল প্রচলিত কুযুক্তি। কোনো বিপদ দেখলেই উনি সত্যিকারের স্কটসম্যান নহেন, অর্থাৎ সহিহ বা খাঁটি নহেন, ইত্যাদি বলতে থাকাকে যুক্তিবিদ্যায় সহিহ (খাঁটি) স্কটসম্যান নহেন কুযুক্তি বলা হয়। নিচের উদাহরণগুলো লক্ষ্য করুন –
১
দাবীঃ জামাতে ইসলামির একজন নেতা যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত হয়েছেন।
কুযুক্তিঃ উনি সত্যিকারের জামাতি নহেন।
২
দাবীঃ আওয়ামী লীগের এক নেতা দুর্নীতির দায়ে জেল খাটছেন।
কুযুক্তিঃ উনি সহিহ (খাঁটি) আওয়ামী লীগার নহেন।
৩
দাবীঃ মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর বার্মিজরা অত্যাচার চালাচ্ছে।
কুযুক্তিঃ যারা অত্যাচার করছে তারা সহিহ (খাঁটি) বার্মিজ নহেন।
৪
দাবীঃ প্যালেস্টাইনে ইসরাইল আবারো আক্রমণ করেছে।
কুযুক্তিঃ ওরা সহিহ (খাঁটি) ইসরাইলী নহেন।
৫
দাবীঃ আই.এস. (ইসলামিক স্টেট) জঙ্গিরা অনেক মানুষকে হত্যা করছে।
কুযুক্তিঃ যারা আই.এস. তারা সহিহ (খাঁটি) মুসলমান নহেন। এটা ইসরায়েলের ষড়যন্ত্র।
৭. ভণ্ডামি আশ্রিত কুযুক্তি (Appeal to Hypocrisy Fallacy) :
১।
ধরুন, আওয়ামী লীগ নেতা সজীব ওয়াজেদ জয় বিএনপি নেতা তারেক জিয়াকে বললো, তুমি একজন দুর্নীতিবাজ।
উত্তরে তারেক জিয়া বললো, তুমিও তো দুর্নীতি করো, বা ডোনাল্ড ট্রাম্পও তো দুর্নীতি করে বা এরশাদও তো দুর্নীতি করেছিল।
২।
প্রস্তাব – ইসলামে নেতৃত্বদানের ক্ষেত্রে নারীর মর্যাদা অসম্মানজনক।
কুযুক্তি – হিন্দু ধর্মে নারীর মর্যাদা কতটুকু? সেখানেও তো অসম্মানজনক।
এই ধরণের উত্তর একটি লজিক্যাল ফ্যালাসি, যাকে বলা হয় অ্যাপিল টু হিপোক্রেসি বা ট্যু ক্যুও-ক্যুই। মানে হচ্ছে, ইউ ট্যু বা তুমিও। কিন্তু অন্য আরেকজন দুর্নীতি করলেই প্রথম জনের দুর্নীতির দাবীটি মিথ্যা হয়ে যায় না। বা হিন্দু ধর্মে নারী অসম্মানজনক অবস্থানে থাকলেই ইসলাম ধর্মে নারীর অবস্থান সম্মানজনক তা প্রমাণ হয় না। এই কুযুক্তিটি ধার্মিক সমাজে বহুল প্রচলিত এবং এই যুক্তি দ্বারাই সাধারণত বিপক্ষকে ধরাশায়ী করার চেষ্টা করা হয়। ইসলামি জঙ্গিবাদের সমালোচনার সময় তারা রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর আক্রমণের উদাহরণ তুলে আনেন, কিন্তু রোহিঙ্গা মুসলিমরা নির্যাতিত হয়ে থাকলে ইসলামি জঙ্গিবাদ তাতে গ্রহণযোগ্য হয় না। আরেকটি অন্যায়ের উদাহরণ প্রথম অন্যায়টিকে ন্যায় বানাতে পারে না।
৮. ঈশ্বরের দোহাই দেয়া বা আপিল টু হ্যাভেন কুযুক্তি
(Appeal to Heaven Fallacy) :
যখন কোন দাবীকে এই যুক্তিতে গ্রহণ করতে বলা হয় যে, “ঈশ্বর এটাই চেয়েছেন” বা “এটাই ঈশ্বরের ইচ্ছা” বা “তিনি ঈশ্বর তাই তিনি এটা করতে পারেন”, তাহলে এই কুযুক্তিটি সংঘটিত হয়। এই কুযুক্তিটিকে ঈশ্বরের দোহাই বা অ্যাপিল টু হেভেন বলে।
উদাহরণ:
১।
বিচারক: কেন তুমি ওদেরকে হত্যা করেছ?
অভিযুক্ত: কারণ ঈশ্বর আমাকে স্বপ্নে এই আদেশ দিয়েছিলেন।
আধুনিক বিচারব্যবস্থার প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিৎ, কারণ আধুনিক বিচারব্যবস্থা এভাবে কাজ করে না। কিন্তু মুশকিল হল মানব-চিন্তা অনেক সময়ই এভাবে কাজ করে। প্রতিদিনই অনেক মানুষ এই ভেবে কোন কাজ করছে যে ঈশ্বর তাই চান, ঈশ্বর এতে খুশি হবেন, এসব কাজ করলে কোন সমস্যা নেই কারণ এটাই ঈশ্বরের বিধান। আর এরকম চিন্তার কারণে অনেকে অন্যের ক্ষতিও করে ফেলেন। আধুনিক বিচারব্যবস্থা এসবের তোয়াক্কা করেনা বলেই হয়তো অন্যের ক্ষতি করার পেছনে এরকম যুক্তি আর খাটে না, অপরাধ তো অপরাধই থাকে।
২।
– কেন ইব্রাহীম ও ইসমাইলের গল্পটিকে একটি “অসাধারণ” ইসলাম ধর্মের কাহিনী হিসেবে পড়ানো হয়? লোকটা তো তার জীবিত সন্তানকে প্রায় জবাই করে ফেলেছিল!
কুযুক্তি : কারণ ইব্রাহীম আল্লাহর ইচ্ছারই অনুসরণ করছিল। এটা ইব্রাহীমের জন্য অনেক কষ্টকর হলেও সে আল্লাহর সন্তুষ্টির কারণে এটা করতে যাচ্ছিল। এটা কি অসাধারণ শিক্ষনীয় ঘটনা নয়?
এখানে বোঝাই যাচ্ছে যে, নিজের সন্তানকে জবাই করতে যাওয়ার গল্প ততক্ষণ পর্যন্তই “অসাধারণ” যতক্ষণ পর্যন্ত এটা ঈশ্বরের ইচ্ছা হয়ে থাকে। ঈশ্বরের ভক্তির জন্য সন্তান হত্যা করার ইচ্ছা পোষণ করলেই সন্তান হত্যা করার চেষ্টা ভাল কাজ হয়ে যায় না, তাতে যতই ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি প্রকাশ পাক। আর তাই এই গল্পটিও “অসাধারণ” হয় না। কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে এরকম ঈশ্বরের ইচ্ছার ব্যাপারটি আনার অর্থ হলো যুক্তিকে ত্যাগ করা। এক্ষেত্রে ঈশ্বরের ইচ্ছা পালন, ঈশ্বরের প্রতি ভক্তিই প্রধান হয়ে যায়, আর সেজন্য কারও ক্ষতি করার ব্যাপারটি নৈতিকতার ঊর্ধ্বেও চলে যেতে পারে। যেমনটা গল্পে ইব্রাহীমের ক্ষেত্রে হয়েছিল, আর তাই এরকম কুযুক্তি বিপজ্জনকও হতে পারে।
৩।
দাবী : নিজের ধর্ম ব্যতীত অন্য ধর্মের লোকজন অধস্তন বা নিকৃষ্টতম প্রাণী – এই কথা কোন মানুষ বলেনি, ধর্মগ্রন্থে স্বয়ং ঈশ্বর বলেছেন। এরকম কথা মানুষ বললে তিনি সাম্প্রদায়িক হবেন, কিন্তু ঈশ্বর যেহেতু সবার সৃষ্টিকর্তা, তাই তিনি এই কথা বলতেই পারেন।
এখানে মানুষের সাথে ঈশ্বরের একটি পার্থক্য সূচিত করে বলা হচ্ছে যে মানুষ এরকম কথা বললে সাম্প্রদায়িকতা হবে, কিন্তু ঈশ্বর এরকম বললে সাম্প্রদায়িকতা হবে না। ঈশ্বর এই কথাটি বলছে বলেই এটা সাম্প্রদায়িক হবে না, এটা সত্য এবং সঠিক হয়ে যাবে। এই কথাগুলোতেও যুক্তি ত্যাগ করা হয়, এবং এটি অ্যাপিল টু হ্যাভেন নামক কুযুক্তি। এছাড়া ঈশ্বরের এই কথাটি মানুষের উদ্দেশ্যেই বলা, মানুষকে জানানোর জন্য ঈশ্বর যেসব আদেশ দেন তাই ধর্মগ্রন্থে লেখা হয়। যেহেতু ঈশ্বরের ধর্মগ্রন্থে এরকম বিধান দেয়া হয়েছে তাই ঈশ্বরের কথা ভেবে মানুষ এটাই বিশ্বাস করে, আর ঈশ্বর এভাবে বলেছেন বলে অন্য ধর্মের লোকেরা অধস্তন, লেস হিউম্যান বা ঊনমানব এরকম দাবী করাকে ঈশ্বরের দোহাই দেয়া কুযুক্তি বলে।
যেমন ধরুন, হিটলার দাবী করতে পারে, ঈশ্বরের নির্দেশেই সে ৬০ লক্ষাধিক ইহুদি নিধন করেছে। বা মাওলানা মওদুদি যখন আহমদীয়াদের ওপর সাম্প্রদায়িক আক্রমণের উষ্কানি দিয়েছে, সেও একই দাবী করতে পারে যে, এটি ছিল আল্লাহর আদেশ। তারা বলতেই পারে, ঈশ্বর ভাল বোঝেন বলেই এই কাজ করতে আদেশ দিয়েছেন। এভাবে আসলে প্রত্যেকেই নিজ নিজ কাজকে ন্যায্যতা প্রদান করতে পারে ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে। সেই কারণে এই যুক্তি কোথাও গ্রহণযোগ্য নয়। এই লজিক্যাল ফ্যালাসি বা কুযুক্তিটি শুধু কুযুক্তিই নয়, বিপজ্জনক ধারণাও বটে।
এই প্রসঙ্গে কথিত ঈশ্বরের আদেশে Deanna Laney murders, Sharon Dalson, আল্লাহর আদেশে রেজওয়ানা হত্যাকাণ্ড, ঈশ্বরের নির্দেশে Samuel Warren Shaffer এর ৮ বছরের বালিকা বিবাহ উল্লেখযোগ্য। এরকম হাজার হাজার ঘটনা রয়েছে যারা ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে নানা অপরাধমূলক কাজ করেছে।
৯. অপ্রাসঙ্গিক তর্কের কুযুক্তি (Red Herring Fallacy) :
দাবীঃ আমার মনে হয় ভুত আছে।
প্রশ্নঃ ভুত যে আছে, তার প্রমাণ কী?
দাবীঃ এই যে আমরা জন্মেছি, মারা যাচ্ছি, এগুলো তো সত্য, তাই না? মারা যে যাচ্ছি, আমরা কোথায় যাচ্ছি?
উপরের দাবীটি লক্ষ্য করুন। দাবীকারী প্রথমে বললো ভুত আছে। প্রমাণ চাওয়া মাত্রই তিনি আলোচনা ভিন্ন একদিকে নিয়ে গেলেন, যেই আলোচনায় তার কথাগুলো আপাত দৃষ্টিতে যুক্তিপূর্ণ মনে হলেও, তিনি অপ্রাসঙ্গিকভাবেই আসলে জন্ম মৃত্যুর প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন। যার সাথে ভুত থাকা না থাকা সম্পর্কহীন। পরের ধাপে তিনি যতই যৌক্তিক কথা বলুন না কেন, তার সকল যুক্তিই কুযুক্তি বলে বিবেচিত হবে। কারণ তিনি মূল প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেছেন।
১০. মিথ্যা উভয়সঙ্কট কুযুক্তি (False Dilemma Fallacy) :
ধরুন, কেউ সমাজতন্ত্রের কঠোর সমালোচনা করছে। সমাজতান্ত্রিক দেশে বাক স্বাধীনতা নেই, সেখানে ধর্ম পালনের অধিকার ব্যক্তিগত পর্যায়ে রাখতে হয় ইত্যাদি। এবং কঠোর সমালোচনার ফলাফল হিসেবে নিয়ে আসছে ইসলামী শরিয়া আইনকে। বোঝাতে চাচ্ছে, যেহেতু সমাজতন্ত্র বাক স্বাধীনতা হরণ করে, তাই দেশে শরিয়া আইনের কোন বিকল্প নেই। যেন মানুষের সমাজতন্ত্র এবং শরীয়া আইন, এই দুইয়ের মধ্যেই পছন্দ করতে হবে। আর কোন বিকল্প নেই। কিন্তু সত্য হচ্ছে, সমাজতন্ত্র বাক স্বাধীনতা খর্ব করলে শরীয়া আইন তার শতগুণ বেশি করে। মানুষের কাছে সমাজতন্ত্র এবং শরীয়া আইন ছাড়াও অনেকগুলো অপশন রয়েছে। যেমন সোশ্যাল ডেমোক্রেসি। এরকম আরও অনেক সুযোগ রয়েছে। তাই সবগুলো পছন্দ সামনে না আনাকে ফলস ডিলেম্মা বা মিথ্যা উভয়সঙ্কট কুযুক্তি বলা হয়। যুক্তিবিদ্যায় এই চালাকিপূর্ণ কুযুক্তিকে খারিজ করে দেয়া হয়।
১১. খড়ের মানুষ হারানো কুযুক্তি (Straw Man Fallacy) :
একজন ব্যক্তি আসলে যা বলেনই নি, সেরকম কিছু তিনি বলেছেন দাবী করে সেই বক্তব্যকে যুক্তি দিয়ে পরাজিত করার যুক্তিকে স্ট্রম্যান ফ্যালাসি বা খড়ের মানুষ বানিয়ে তার সাথে যুদ্ধ করার কুযুক্তি বলে। ধরুন –
বক্তা ১ বলেছেন, আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না।
বক্তা ২ বলছেন, বক্তা ১ আসলে ফ্রি সেক্স করার জন্য ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না। ফ্রি সেক্স খুব খারাপ। ফ্রি সেক্সে অনেক সামাজিক সমস্যা তৈরি হয়। (এরপরে তিনি দীর্ঘ পাঁচ ঘণ্টা ফ্রি সেক্সের ভাল খারাপ বিষয় নিয়ে বক্তব্য দিয়ে গেলেন। অথচ বক্তা ১ ফ্রি সেক্স বিষয়ক কিছু উল্লেখই করেন নি।)
লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, বক্তা ২ হয়তো ফ্রি সেক্সের ভাল খারাপ বিষয়ে কিছু বক্তব্য দিয়ে মাঠ গরম করতে চাচ্ছিলেন, তাই ঈশ্বরের অস্তিত্ব অনস্তিত্ব সম্পর্কে আলোচনা না করে উনি নিজেই বিপক্ষের বক্তার একটি বানানো আর্গুমেন্ট তৈরি করলেন, এবং সেটাকে হারিয়ে দিলেন। একজন যেমন খড় দিয়ে মানুষ বানিয়ে তার সাথে মল্লযুদ্ধ করে যুদ্ধ জয় করার ভান ধরে, খুব বীরত্ব দেখানো হয়েছে বলে সবাইকে বোঝাতে চায়, ঠিক তেমনি, বক্তা ১ যা আসলে বলেনই নি, সেই আর্গুমেন্ট বানিয়ে বক্তা ২ নিজেই যুদ্ধে জয়লাভ করে বসলেন। ঈশ্বরের অস্তিত্ব অনস্তিত্বের সাথে ফ্রি সেক্স অথবা কোন ধরণের সেক্সই প্রাসঙ্গিক নয়। এরকম যুক্তি উপস্থাপনের চেষ্টাকে খড়ের মানুষ হারানো কুযুক্তি বলা হয়।
১২. পক্ষপাতদুষ্ট নিশ্চিত কুযুক্তি Confirmation Bias Fallacy :
যেহেতু আপনি হিন্দু পরিবারে জন্মেছেন এবং ছোটবেলা থেকে হিন্দু ধর্মকেই সত্য বলে মেনে নিয়েছেন, তাই আপনার দাবী হচ্ছে, পৃথিবীর প্রায় ৪২০০ টি ধর্মের মধ্যে একমাত্র আপনার ধর্মটিই সত্য এবং সঠিক। বাদবাকি ৪১৯৯ টি ধর্মের সবই ভুয়া এবং বিকৃত। আপনি বাংলাদেশের কোন মুসলিম পরিবারে জন্মালে ঠিক একইভাবে একই যুক্তিতে ইসলাম ধর্মটিই পৃথিবীর একমাত্র সত্য ধর্ম বলে তখন আপনার মনে হতো। যেহেতু কোন ধর্মটি সঠিক তা তথ্য প্রমাণ দিয়ে যাচাই বাছাই না করে শুরুতেই আপনি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, জন্মসূত্রে পাওয়া আপনার ধর্মটিই একমাত্র সঠিক, তাই আপনার দাবী পক্ষপাতদোষে দুষ্ট। আর আপনার এই যুক্তিটি একটি কুযুক্তি। পৃথিবীর বেশিরভাগ ধার্মিক মানুষই মনে করেন, তিনি যেই পরিবারে ঘটনাচক্রে জন্মেছেন, সেই পরিবারের ধর্মটিই একমাত্র সত্য। তিনি তার ধর্মের সপক্ষে যেসকল যুক্তি আছে, সেগুলো খুঁজে বের করেন, এবং সেইগুলোই প্রচার করেন। তার ধর্মের বিপক্ষের যুক্তিগুলোকে তিনি এড়িয়ে যান বা বাতিল করে দেন।
১৩। এড হোমিনেম (সারকামস্টেনশিয়াল)
Appeal to Motive Fallacy :
কোন যুক্তির পেছনে যুক্তিদানকারীর স্বার্থ রয়েছে, এমনটা দেখিয়ে যুক্তি বা দাবীকে ভুল বললে বা নাকোচ করলে এই কুযুক্তিটি সংঘটিত হয়। এখানে যুক্তির বিপক্ষে যুক্তি নয়, যুক্তিদানকারী কী উদ্দেশ্যে যুক্তি দিচ্ছে, সেই নিয়েই আলোচনা চলে।
উদাহরণঃ
১। ধরা যাক, ইসলাম ধর্মের শিশু বিবাহ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। এরকম অবস্থায় একজন বললো, আপনি ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে যুক্তি দিচ্ছেন, নিশ্চয়ই আপনি ইহুদী খ্রিস্টানদের থেকে টাকা পয়সা নিচ্ছেন।
– এখানে, ইসলামের পক্ষে যিনি বলছেন, তিনি শিশু বিবাহের ভাল খারাপ দিক নিয়ে যৌক্তিক আলোচনা না করে কী উদ্দেশ্যে কেউ এই যুক্তি দিচ্ছে, কার থেকে টাকা পয়সা পাচ্ছে, তার দিকে নির্দেশ করছেন। যুক্তিবিদ্যায় একে এড হোমিনেম ফ্যালাসি বা কুযুক্তি বলে। উল্লেখ্য, ইহুদী খ্রিস্টানদের থেকে যদি কেউ টাকা নিয়েও থাকে, তাতেও শিশু বিবাহের বিরুদ্ধে যিনি উপযুক্ত যুক্তি দিচ্ছেন, সেই যুক্তিটি ভুল প্রমাণিত হয় না।
১৪. প্রাধিকারের কুযুক্তি Argument from Authority Fallacy :
দাবীঃ অমুক বিজ্ঞানী ভাগ্য পরিবর্তনের আংটি পরতো, তাই আংটি ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারে।
দাবীঃ অমুক দর্শনের পণ্ডিত পীরবাবার পানিপড়া খেতো, অতএব পানিপড়া খেলে অসুখ সারে।
দাবীঃ অমুক বিখ্যাত ডাক্তার ওঝার শরণাপন্ন হয়েছিল, অর্থাৎ ওঝা রোগ সারাতে পারে।
উপরের দাবীগুলোকে প্রাধিকারের কুযুক্তি বলে। কোন বিশিষ্ট ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে এক ধরণের কর্তৃত্ব আরোপ করা, এবং তার নামকে যুক্তি হিসেবে ব্যবহার করাকে কুযুক্তি হিসেবে গণ্য করা হয়। এই ধরণের ঘটনা কোনকিছু প্রমাণ বা অপ্রমাণ করতে পারে না। কোন বিখ্যাত মানুষ কী বলেছেন বা করেছেন বা শুনেছেন, তার ওপর যুক্তি নির্ভরশীল নয়। যেমন, বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং এর নাস্তিক হওয়া নাস্তিক্যবাদের যথার্থতার কোন প্রমাণ নয়। আবার একইভাবে, নিউটনের আস্তিক থাকাটিও ঈশ্বরের অস্তিত্বের সপক্ষের প্রমাণ নয়। ঈশ্বর আছে কী নেই, তা স্টিফেন হকিং বা আইজ্যাক নিউটনের ব্যক্তিগত বিশ্বাস অবিশ্বাসের ওপর নয়, ঈশ্বরের সপক্ষে কতটুকু যুক্তি রয়েছে তার ওপর নির্ভরশীল। তা ব্যক্তির বিশ্বাস অবিশ্বাস নিরপেক্ষ। কে কত বড় বিখ্যাত বা অখ্যাত বা পণ্ডিত বা বিশেষজ্ঞ, তার উল্লেখ করে তাদের বিশ্বাস বা অবিশ্বাসকে প্রমাণ করা যায় না। তবে, স্টিফেন হকিং বা আইজ্যাক নিউটন যেসমস্ত যুক্তি বা প্রমাণ ব্যবহার করেছেন, সেগুলো যুক্তি হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। কিন্তু যুক্তিহীনভাবে বিখ্যাত কারও নাম উল্লেখ করে কোন দাবী করলে সেই দাবীকে প্রাধিকারের কুযুক্তি বলা হয়।
১৫. জনপ্রিয়তার কুযুক্তি :
Argument From Popularity/ Argumentum ad Populum Fallacy
দাবীঃ ইসলাম ধর্ম যদি সত্য নাই হয়ে থাকে, তাহলে পৃথিবীর ১৬০ কোটি মুসলমান কেন ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস করে?
দাবীঃ বিবর্তনবাদ যদি সত্য হয়েই থাকে, তাহলে পৃথিবীর সব আব্রাহামিক ধর্মের ধার্মিক মানুষ কেন তা অবিশ্বাস করে?
জনসংখ্যার কত অংশ কী বিশ্বাস করে, বা কোন মতবাদটি কতটুকু জনপ্রিয়, যুক্তি তার ওপর নির্ভর করে না। যুক্তি বা বিজ্ঞান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নয় যে, কত মানুষ তা মানলো সেটার ওপর নির্ভর করবে। যুক্তি শুধু তথ্য প্রমাণ এবং যুক্তির যথার্থতার ওপর নির্ভরশীল। পৃথিবীর সকল মানুষও যদি অযৌক্তিক কিছু বলে, শুধু একজন যদি যৌক্তিক কথা বলে, তাহলে ঐ একজন ব্যক্তিই সঠিক। যেমন, পৃথিবীর প্রায় দুইশত কোটি মানুষ ইসলামে বিশ্বাস করলে সেটা যেমন কোন যুক্তি নয়, ঠিক একইভাবে, পৃথিবীর বাকি প্রায় ছয়শত কোটি মানুষ যেহেতু ইসলামে বিশ্বাসী নয়, সেহেতু ইসলাম মিথ্যা, সেটাও ভুল যুক্তি বা কুতর্ক বা হেত্বাভাস বা লজিক্যাল ফ্যালাসি। কোন দাবীর সত্যতা সেই দাবীটির তথ্য প্রমাণ এবং যুক্তির ওপর নির্ভরশীল, তা কতজন বিশ্বাস বা অবিশ্বাস করে তার ওপর নয়।
আজ এই পর্যন্ত, ১৬ থেকে বাকি বহুল প্রচলিত কুযুক্তিগুলো পরবর্তী পর্বে তুলে ধরবো। ভালো থাকবেন এবং পাশে থাকবেন। কোন যুক্তি না বুঝলেও কমেন্ট করে জানাবেন এবং পরিচিতদের পড়তে উৎসাহিত করবেন।
– সংশয়