পরকাল না থাকলে মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য কি?

মুমিন ভাইটি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, স্রষ্টা না থাকলে, পরকালে বিচার আচার, পুরষ্কার বা শাস্তি না থাকলে, বেহেশত দোজখ না থাকলে আমাদের অস্তিত্বের কোন উদ্দেশ্যই থাকে না। এগুলো না থাকলে আমাদের অস্তিত্ব অর্থহীন হয়ে যায়। কোন আলটিমেট উদ্দেশ্য না থাকলে বেঁচে থাকার কোন মানে হয় না। তাহলে নাস্তিকদের এই অর্থহীন জীবনের মানে কী? তারা মরে যাচ্ছে না কেন?

প্রশ্নটির উত্তর দেয়ার আগে আমার জানা দরকার, যেই স্রষ্টার কথা আপনি বলছেন, সেই স্রষ্টার কী কোন স্রষ্টা আছে? তার কি পরকালে বিচার আচার হবে? পুরষ্কার বা শাস্তির বন্দোবস্ত আছে? সেও কী ভাল কাজ করলে আরেক বেহেশতে যেতে পারবে? তাহলে স্রষ্টার অস্তিত্বের উদ্দেশ্য কী? আপনার বিশ্বাস অনুসারে, সেগুলো নেই। সুতরাং আপনারই যুক্তি অনুসারে, ঈশ্বরের অস্তিত্ব একটি অর্থহীন অস্তিত্ব। সেটি একইসাথে অপ্রয়োজনীয়। সে মরে যাচ্ছে না কেন? সে কী মরতে সক্ষম নয় বলে বেঁচে আছে?

প্রিয় মুমিন ভাইটি আমার, নিজের মগজটি ব্যবহার করুন। নাস্তিকদের প্রতি ছুড়ে দেয়া আপনারই যুক্তি আপনার ঈশ্বরের ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন তো? সেখানে ব্যবহার করলে আপনি নিজেও নিজের যুক্তি মানছেন না। বা স্পেশাল প্লিডিং কুযুক্তির ব্যবহার ছাড়া আপনার ঈশ্বরের অস্তিত্বের কোন সার্থকতা থাকে না।

এবারে আসুন, ধরে নিচ্ছি, মানুষের অস্তিত্বের উদ্দেশ্য হচ্ছে কোন এক বুঙ্গাপুঙ্গা দেবতার উপাসনা করা। তো, উপাসনা করলাম। এরপরে জান্নাতে গিয়ে হুর গেলমান পেলাম। এতপরে কী? সেখানে গিয়ে যা করবো, তারপরে কী হবে?

মানে জিজ্ঞেস করছি, পরকালে জান্নাতের জীবনের উদ্দেশ্য তখন কী থাকবে? সেই জীবনের পরে আরো যদি কোন জীবন না থাকে, পরকালের পরকাল না থাকে, তাহলে সেই জীবনটিও তো উদ্দেশ্যহীন হয়ে যায়। তাহলে সেই সময়ে আমাদের অস্তিত্বের সার্থকতা কোথায় থাকবে? সেই জীবনটিও তো অর্থহীন হয়ে যাবে, আপনারই যুক্তি অনুসারে।

আপনারই দেয়া যুক্তি ব্যবহার করে আমি দেখাচ্ছি, আপনার এইসব যুক্তির দুর্বলতা কোথায়। কীভাবে এই একই যুক্তিগুলো আপনার মতাদর্শের ক্ষেত্রে ব্যবহার করে আমরা আপনার মতাদর্শকে উদ্ভট একটি মতাদর্শ হিসেবে প্রমাণ করতে পারি। এখানে বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে, এই যুক্তিগুলো কিন্তু আমাদের নয়। আপনার যুক্তি ব্যবহার করেই আপনার মতাদর্শকে অযৌক্তিক দাবী বলে প্রমাণ করা সম্ভব।

এবারে আসুন, মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য তাহলে কী হতে পারে। একটি জীব হিসেবে আসলে প্রতিটি জীবেরই একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, টিকে থাকার চেষ্টা এবং পরবর্তী প্রজন্মে নিজের অস্তিত্ব রেখে যাওয়া। এই টিকে থাকার সংগ্রামে দেখা গেছে, একটি প্রাণী কখনো একা টিকে থাকতে পারে না, অথবা বলা যায় একা টিকে থাকা তার জন্য কঠিন। তাই আশপাশের প্রাণীগুলোকে নিয়ে টিকে থাকার চেষ্টাই জীবজগতের মধ্যে প্রকট হয়ে উঠেছে। প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হলে বা অন্য সবাইকে মেরে ফেললে আমাদের টিকে থাকা কষ্টকর হয়ে ওঠে। তাই প্রাণী জগতের মধ্যে গড়ে ওঠে এমপ্যাথি। এক প্রাণীর প্রতি আরেক প্রাণীর মমতা। খাদ্যের জন্য তারা একে অন্যকে আক্রমণ করে, কিন্তু বিনা প্রয়োজনে হত্যা করে খুব কম সংখ্যক প্রাণী।

আবার, শুধুমাত্র মানুষ হিসেবে আমাদের উদ্দেশ্য আমরা প্রত্যেকেই নিজেরা ঠিক করি। যেমন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন অন্যদের সুশিক্ষিত করে গড়ে তুলতে। বিধবাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে। আব্রাহাম লিঙ্কনের জীবন সংগ্রাম ছিল দাসপ্রথার বিরুদ্ধে। ম্যান্ডেলার জীবন ছিল কালো মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য। আবার, উল্টোদিকে আইসিস বা আল কায়েদার সদস্যদের জীবনের উদ্দেশ্য ছিল কাফের মেরে দুনিয়ায় আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠা করার। হলি আর্টিজানের জঙ্গিদের জীবনের উদ্দেশ্য ছিল আল্লার ত্রাস, ইসলামের ভীতি সৃষ্টি করার। প্রতিটি মানুষই এভাবে নিজ নিজ উদ্দেশ্য নিজেই ঠিক করে। তার বেড়ে ওঠা, পরিবার পরিজন আত্মীয়স্বজন, শিক্ষাদীক্ষা, যুক্তি এবং মানবিক বোধ এসব ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে।

আবার, মানুষ তার জীবনের ছোট ছোট উদ্দেশ্যও নিজেরাই ঠিক করে। যেমন একটি ভাল চাকরি। একটি ভাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া। কোন কাজে সফল হওয়া। কারো সাথে প্রেম ভালবাসা করা। কতকিছু। যেমন, আমি একটি ফুলের গাছ লাগিয়ে রোজ পানি দিচ্ছি। এই আশায় যে, একদিন ফুল ফুটবে। নাও ফুটতে পারে। আবার ফুটলেও, তাতেও আসলে মহাবিশ্বের কোন লাভ ক্ষতি নেই। কিন্তু ফুল ফুটলে যেই আনন্দটুকু হবে, সেটি অমূল্য। সেটি অবশ্যই অর্থবহ।

বা ধরুন, একটি আহত চড়ুই পাখী হঠাৎ আমার ঘরে ঢুকে পড়েছে। বা রাস্তায় একটি কালো কুকুর আহত হয়েছে। চড়ুই পাখীটি বা কুকুরটিকে খাওয়ানো, সুস্থ করে তোলা, ঔষধপত্র দেয়া, এগুলো আমি কী উদ্দেশ্যে করবো? বেহেশতে উঁচু উঁচু স্তনের হুর পাওয়ার জন্য? মুক্তোর মত ঝকঝকে গেলমান পাওয়ার জন্য? আমি যদি উঁচু স্তনের হুর কিংবা মুক্তোর মত গেলমানের উদ্দেশ্যে কাজটি না করে শুধুমাত্র আমার ভাললাগার জন্য কাজটি করি, তাহলে কাজটি কী অর্থহীন হয়ে যায়?

এই ছোট ছোট উদ্দেশ্যগুলোই মানুষের জীবনকে অর্থবহ করে তোলে। হুর গেলমানের উদ্দেশ্য না থাকলে কোন কাজ অর্থহীন হয়ে যায়, এরকম ধারণা শুধুমাত্র স্বার্থপর এবং নিচু মানসিকতার মানুষের পক্ষে ভাবা সম্ভব। দুঃখজনক বিষয়টি হচ্ছে, অধিকাংশ ধর্মই মানুষকে এরকম নিচু নৈতিকতার শিক্ষা দিয়ে বড় করে তোলে। তাদের কথা শুনলে মনে হয়, হুর না পেলে তারা কেন একটি আহত কুকুরকে সুস্থ করে তুলবে?

তাছাড়া, তারাই বিশ্বাস করে যে মানুষ ছাড়া অন্যকোন প্রাণীর জীবনের কোন উদ্দেশ্য নেই৷

এই ধরণের চিন্তা যে শুধু অসুস্থ তাই নয়, ভয়ঙ্করও বটে।

-Asif Mohiuddin

Forhad H Fahad

Related Posts

পরকাল নিয়ে মুমিনদের বহুল জিজ্ঞেসিত প্রশ্নের জবাব

প্রশ্ন : পরকাল না থাকলে যেসব অপরাধীদের দুনিয়াতে উপযুক্ত শাস্তি দেয়া সম্ভব হচ্ছে না তাদের বিচার কিভাবে হবে? জবাব : ১. আপাততদৃষ্টিতে যদিও আমরা ধরে নিই যে পরকাল থাকলে আসলেই অপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত হতো এবং খুব ভালো হতো, তার মানে কি এই যে পরকাল আছে বা পরকাল সত্য? অর্থাৎ কোনকিছু হলে বা থাকলে ভালো হতো, তার মানে তো এই নয় যে সেটা সত্য বা আছে। উদাহরণসরূপ : আপনি…

Read more

ধর্ম না থাকলে মানুষ নৈতিকতা শেখবে কোথা থেকে? 

ধরুন, একজন আধুনিক সভ্য মানুষ হিসেবে আপনার কাছে অবশ্যই যুদ্ধবন্দী নারীকে গনিমতের মাল হিসেবে বিছানায় নেয়া খুবই নিন্দনীয় কাজ বলে গণ্য হবে। কিন্তু এই কাজটি আপনার নবীজী নিজ জীবনে কয়েকবারই করেছেন, এবং অন্যদেরও করতে বলেছেন। বা ধরুন আপনি এমন কারও সাথে আপনার বোন বা কন্যাকে বিয়ে দেবেন না, যার ইতিমধ্যে তিনজন স্ত্রী আছে। আপনার বিবেক, বুদ্ধি, আধুনিক মূল্যবোধ, আধুনিক ধ্যান ধারণা আপনাকে সেইসব মধ্যযুগীয় কাজ করতে বাধা দেবে। যদিও…

Read more

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Latest

আমাদের জাতীয় সঙ্গীত কি হিন্দু শাক্তদেবী মা-কালীকে উদ্দেশ্য করে লেখা?

আমাদের জাতীয় সঙ্গীত কি হিন্দু শাক্তদেবী মা-কালীকে উদ্দেশ্য করে লেখা?

একেই কি বলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা?

একেই কি বলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা?

কর্ণচিকিৎসা

কর্ণচিকিৎসা

তাকদীর বিষয়ক রেফারেন্স

তাকদীর বিষয়ক রেফারেন্স
কুদরত

পরকাল নিয়ে মুমিনদের বহুল জিজ্ঞেসিত প্রশ্নের জবাব

পরকাল নিয়ে মুমিনদের বহুল জিজ্ঞেসিত প্রশ্নের জবাব